তিশা তার আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “যা দিবে তাই খাব আম্মু। একা একা খেতে ইচ্ছা করে না।”
আম্মু তিষার দিকে তাকিয়ে একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেললেন, মেয়েটি এই কথাটি একটুও ভুল বলেনি। একা বসে বসে খাওয়ার চাইতে বড় বিড়ম্বনা আর কিছু হতে পারে না।
.
রাত্রে তিনজন খেতে বসেছে, তিষা তার স্প্যাগোটির উপর ঘন লাল রংয়ের একটা সস ঢালতে ঢালতে বলল, “আম্মু তোমাদের এই কাজটা ঠিক হয়নি।”
আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “কোন কাজটা?”
“এই যে আমি একা। আমার কোনো ভাইবোন নেই।”
আলু খেতে খেতে বললেন, “তাতে তোর সমস্যা কী? তুই একা তোর আদর যত্নে কেউ ভাগ বসাচ্ছে না।”
তিষা বলল, “আমার আদর যত্নে ভাগ বসালেও একটুও কম পড়বে আব্বু। তোমার এটা ঠিক যুক্তি না।”
“তাহলে কোনটা ঠিক যুক্তি।”
“একটা ছেলে কিংবা মেয়ে যদি একা বড় হয় তাহলে সে স্বার্থপর হয়ে বড় হয়। আমি নিশ্চয়ই স্বার্থপর হয়ে বড় হচ্ছি।”
আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “হচ্ছিস নাকী?”
তিষা বলল “সেটা তো আর আমি বুঝতে পারব না, তোমরা বুঝবে।”
আব্বু বললেন, “আমরা যখন বুড়ো হব তখন যদি ওল্ড হোমে আমাদের দেখতে না আসিস তাহলে বুঝব স্বার্থপর হয়েছিস।”
“তোমাদের আরো ছেলেমেয়ে হওয়া উচিৎ ছিল আম্মু।”
“একটা নিয়েই পারি না আরো ছেলে মেয়ে!”
তিষা বলল, “কী বলছ আম্মু? আমি তোমাকে কখনো জ্বালাতন করেছি?”
“এখন করিস না। কিন্তু তুই যখন ছোট ছিলি” আব্বু বললেন, “বাপরে বাপ! এমন কোনো অসুখ নাই যে তোর হয় নাই। তোর মেজাজ ছিল গরম, সারা রাত চিৎকার করতি, বাসার কারো ঘুম নাই খাওয়া নাই–”
“আমি বিশ্বাস করি না।”
“তুই বিশ্বাস করিস কী না করিস তাতে কিছু আসে যায় না। সত্য হচ্ছে সত্য।”
তিষা তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আম্মু, আমার বয়স তেরো। তোমার বয়স যখন পঁচিশ তখন আমার জন্ম হয়েছে। তার অর্থ তোমার বয়স এখন আটত্রিশ। আটত্রিশ বছরে আমেরিকার মহিলাদের ধুমাধুম বাচ্চা হচ্ছে।”
আম্মু চোখ ছোট করে বলল, “তুই কী বলতে চাইছিস?”
“আমি বলতে চাচ্ছি যে তোমার এখনো বাচ্চা নেয়ার বয়স আছে। একটা বাচ্চা নিয়ে নাও। মেয়ে হলে খুবই ভালো ছেলে হলেও চলবে।”
আম্মু খপ করে তিষার চুলের মুঠি ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “বেশী মাতবর হয়েছিস, মাকে পরামর্শ দিস কীভাবে বাচ্চা নিতে হবে?”
তিষা “আউ আউ” করে প্রয়োজন থেকে অনেক জোরে চিৎকার করে মাথাটা সরিয়ে নিতে নিতে বলল, “আমার ভালো মন্দ নিয়ে আমি পরামর্শ দিতে পারব না? আমার একা একা বাসায় ঢুকতে কতো খারাপ লাগে তুমি
জানো? ছোট একটা বোন না হয়ে ভাই হলে কতো মজা হতো!”
আব্বু মাথা নাড়লেন, বললেন, “নো। ভাই বোনের জন্যে দেরী হয়ে গেছে। খুব বেশী হলে তোকে একটা কুকুরের বাচ্চা কিনে দিতে পারি।”
আম্মু চোখ কপালে তুললেন, “কুকুর? ঘরের মাঝে একটা দামড়া কুকুর ঘুরে বেড়াবে? ছিঃ!”
তিষা বলল, “কেন মা? কুকুর তো থাকেই। আমার স্কুলের সব বন্ধুর কুকুর আছে!”
“থাকুক। তাই বলে আমার বাসার ভিতরে একটা কুকুর ঘুরে বেড়াতে পারবে না।”
“কেন মা? দেশে আমাদের বাসায় একটা বিড়াল ছিল মনে নাই? যদি বাসায় বিড়াল থাকতে পারে তাহলে কুকুর থাকলে দোষ কী?”
“বিড়াল কত ছোট, কুকুর কতো বড়”
আব্বু বললেন, “ছোট ব্রীডের কুকুরও আছে। বিড়ালের সাইজ!”
আম্মু বললেন, “বাসায় পোষাপাখী রাখা খুব সোজা ব্যাপার না। এটাকে খাওয়াতে হয় বাথরুম করাতে হয় সব দায়িত্ব নিতে হয়।”
তিষা সোজা হয়ে বসে মুখ শক্ত করে বলল, “আম্মু, তুমি যদি বিশ্বাস করে আমাকে একটা ছোট ভাই কিংবা বোন দিতে আমি তাকে পর্যন্ত দেখে শুনে রাখতাম। আর ছোট একটা কুকুরের বাচ্চাকে দেখে শুনে রাখতে পারব না?”
কাজেই পরের উইক এন্ডেই তিষা তার আব্বুকে নিয়ে একটা পেট স্টোর থেকে ছোট একটা কুকুরের বাচ্চা আর কুকুর পালার উপর একটা বই কিনে আনল। দোকানে অনেক ধরণের কুকুর, তাদের দামও অনেক, তিষা তার মাঝে বেছে বেছে ছোট একটা বাদামীর মাঝে সাদা আর কালো রংয়ের কুকুর বেছে নিল। এটাকে এখানে বলে বিগল, বড় বড় চোখ, ঝোলা কান। দেখলেই আদর করার ইচ্ছে করে।
কুকুরটার এমন মায়া কড়া চেহারা যে বাসায় আনার পর তাকে দেখে আম্মুর মুখে পর্যন্ত হাসি ফুটে উঠল। রান্না ঘরের মেঝেতে ছেড়ে দেবার পর। সেটা কুঁই কুঁই শব্দ করে মেঝে শুকতে শুকতে এদিকে সেদিক ঘুরতে থাকে। নূতন জায়গায় এসে তার মাঝে এক ধরনের অনিশ্চয়তার ভাব, কোথায় যাবে কার কাছে একটুখানি আদর পাবে সেটা নিয়ে এক ধরনের দুর্ভাবনা। কিছুক্ষণের মাঝেই অবশ্যি বুঝে গেল তিষা হচ্ছে তার আসল মালিক তাই সে গুটিশুটি মেরে তার কোলে এসে বসে পড়ল। তিষা আদর করে বুকে চেপে ধরে বলল, “সোনামনি আমার। টুই টুই টুই।”
আব্বু হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী নাম দিবি তোর কুকুরের?”
তিষা এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, “টুইটি।”
“টুইটি একটা পাখীর বাচ্চার নাম।”
“হোক। আমার এই টুনটুনির নাম টুইটি।”
আম্মা বললেন, “টুনটুনি একটা পাখী। কুকুরের বাচ্চা কবে থেকে পাখী হল।”
তিষা বলল, “আমি এতো কিছু বুঝি না।” তারপর কুকুরের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল, “বুঝলি টুনটুনি? আজ থেকে তোর নাম টুইটি। টু-ই টি।”
কুকুরের বাচ্চাটা কী বুঝল কে জানে, মাথা তুলে ভৌ ভৌ করে একবার ডাকল। তিষা তার আলু আর আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখেছ, টুইটি তার নামটাকে পছন্দ করেছে!”