তিষা স্কুল বাসের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হল। এখানে সব কিছু কেমন ছিমছাম, সবকিছু কী চমৎকার নিয়ম দিয়ে বাধা। এই যে সে রাস্তা পার হচ্ছে তার জন্যে রাস্তার দুই পাশে সব গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। স্কুল বাসটা যতোক্ষণ তার বাতি জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে ততক্ষণ কোনো গাড়ী চলতে পারবে না, স্কুলের ছেলেমেয়েরা যেন ঠিকমত রাস্তা পার হতে পারে। তিষার ছোট চাচা দেশে গাড়ী একসিডেন্টে মারা গিয়েছিলেন। ছোট চাচা রাস্তা পার পর্যন্ত হচ্ছিলেন না, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন একটা গাড়ী আরেকটা গাড়ীকে ওভারটেক করে যাবার সময় তাকে চাপা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। সেই গাড়ীটাকে কোনোদিন ধরা পর্যন্ত যায়নি।
তিষা রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে তাদের এলাকায় ঢুকে গেল। কী সুন্দর ছিমছাম শান্ত পরিবেশ। সামনে সবুজ লন, ছবির মতো একেকটি বাসা, পিছন থেকে ঝাউগাছ উঁকি দিচ্ছে। যেদিন রোদ ঝলমল সুন্দর একটি দিন হয় সেদিন সবকিছুকে রঙিন মনে হয়। মনটা ভালো থাকে তাই মনে হয়, সবকিছুকে মনে হয় আরো বেশী রঙিন দেখায়। আজ আকাশে মন খারাপ করা মেঘ, তাই চারপাশে একটা বিষণভাব।
তিষা হেঁটে হেঁটে তাদের বাসার দিকে যেতে থাকে, কোথাও কোনো মানুষ নেই। প্রথম যখন এদেশে এসেছিল তার মনে হতো মানুষজন সব গেল কোথায়? তার অনেকদিন লেগেছে বুঝতে যে এদেশে মানুষজনই কম। যে এলাকা যত বড়লোকদের সেখানে মানুষ তত কম। তিষার বন্ধুরা বলেছে। নিউইয়র্ক শহরে নাকী অনেক মানুষ। তিষার আব্বু বলেছেন এর পরের বার। ছুটিতে নিউইয়র্কে বেড়াতে যাবেন। নিউইয়র্ক শহর নাকি খুব মজার। একটা শহর কীভাবে মজার হয় তিষা অবশ্যি বুঝতে পারে না। একটা মানুষ মজার হতে পারে, তাই বলে আস্ত একটা শহর?
বাসার সামনে এসে তিষা একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলল। সামনে কোনো গাড়ী নেই, যার অর্থ তার আব্বু কিংবা আম্মু কেউ আসেননি। আব্বু অবশ্যি কখনোই আগে চলে আসেন না। আম্মু মাঝে মাঝে চলে আসেন। তখন তাকে আর খালি বাসায় ঢুকতে হয় না। খালি বাসায় ঢোকার মাঝে কেমন জানি খুব একটা মন খারাপের বিষয় আছে। দুই বছর আগে তারা যখন প্রথম এই দেশে এসেছিল তখন দেশের অনেক কিছুর জন্যে মন খা খা করতো। আস্তে আস্তে সবকিছুতে অভ্যাস হয়ে গেছে, শুধু এই একটা বিষয় তার অভ্যাস হয়নি। এখনো তার খালি একটা বাসায় ঢুকতে মন খারাপ হয়ে যায়। দেশে তার চাচা ফুপুরা সবাই মিলে একটা বিল্ডিংয়ে থাকতো তাদের সবার বাচ্চা কাচ্চারা মিলে তাদের একটা বিশাল পরিবার ছিল, বাসায় ঢোকার আগেই অনেক দূর থেকে সব বাচ্চা কাচ্চাদের চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যেতোকী মজার একটা সময় ছিল! তিষা ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার ব্যাগ থেকে বাসার চাবি বের করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। ছিমছাম সুন্দর একটা ডুপ্লেক্স, তার ঘরটা, দোতলায়। তিষা তার স্কুল ব্যাগটা কার্পেটে রেখে নিচে সোফায় বসে পড়ল। রাস্তার জুতো পরে বাসার কার্পেটের উপর চলে এসেছে, মা দেখলে নিশ্চয়ই রাগ করবেন, কিন্তু মা বাসায় নেই রাগ করবেন কীভাবে?
তিষা কফি টেবিলে পা তুলে চুপচাপ বসে থাকে। তার বয়স তেরো, এখন সে আনুষ্ঠানকিভাবে টিন এজার হয়েছে। দেশে থাকতে সে যখন আমেরিকায় গল্প শুনেছে তার বেশীর ভাগ ছিল টিন এজারদের গল্প। সে এখন এই আমেরিকার টিন এজার, এখন তার অনেক আনন্দ হওয়ার কথা। তার কী আনন্দ হচ্ছে? স্কুলে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ অনেক মজা হয় সেটি সত্যি। রাত্রি বেলা যখন আব্বু আম্মু থাকে তখনও সময়টা কেটে যায়, তারপরেও বিশাল একটা সময় সে একা থাকে। কম্পিউটারের সামনে বসে মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে সময় কাটায় কিন্তু সেটা কেমন জানি কৃত্রিম। একজন মানুষকে সামনাসামনি না দেখলে তার সাথে কী কথা বলা যায়? অনেকেই পারে। তিষা পারে না।
তিষার খিদে পেয়েছে। ফ্রীজ খুললেই দেখবে আম্মু তার জন্যে খাবার রেডি করে রেখেছেন। মাইক্রোওয়েভে গরম করে সে খেতে পারবে। টিভিটা চালিয়ে দিলেই কোথাও না কোথাও একটা সিটকম খুঁজে পাওয়া যাবে, দর্শকদের কৃত্রিম হাসি শুনতে শুনতে এক সময় সে নিজেও একজন কৃত্রিম দর্শক হয়ে টেলিভিশনের চরিত্রগুলোকে দেখে হাসতে থাকবে। কিন্তু তিষার সোফা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না। সে কফি টেবিলে পা তুলে দিয়ে জানালার ভেতর দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। ধূসর মন খারাপ করা একটি আকাশ। একটু পর মনে হয় টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হবে, তখন মনে হয় আরো বেশী মন খারাপ হয়ে যাবে।
.
সোফায় বসে থাকতে থাকতে তিষা এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। সন্ধেবেলা আম্মু কাজ থেকে ফিরে এসে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখলেন তিষা সোফায় ঘুমিয়ে আছে, পা থেকে জুতো পর্যন্ত খুলেনি। আম্মু একটু ভয় পেয়ে তিষাকে ধরে একটা ছোট ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন,”তিষা মা, এখানে ঘুমাচ্ছিস?”
তিশা ধড়মড় করে উঠে বসল, একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “হায় খোদা! আমি ঘুমিয়ে পড়েছি!”
“জুতো পর্যন্ত খুলিস নি? শরীর ভালো থাছে তো?”
“হ্যাঁ আম্মু শরীর ভালো আছে। যা খিদে পেয়েছে–”
“স্কুল থেকে এসে কিছু খাসনি।”
“আলসেমি লাগছিল।” বলে তিষা অপরাধীর মত হাসল।
“যা কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে আয়। কী খাবি বল।”