তিষা আর জন কেউ কোনো কথা বলল না। তিষা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে এই মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইল, পৃথিবীতে সত্যিই এরকম মানুষের জন্ম হতে পারে? একজন মানুষ সত্যিই এরকম রাক্ষুসী হতে পারে?
লিডিয়া তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল, হেঁটে হেঁটে তিষার সামনে এসে দাঁড়াল, তারপর তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার নিজের একটা দেশ ছিল, গরীব মানুষের দেশ, সেই দেশ ছেড়ে বড়লোকের দেশে এসেছ। কাজটা ভালো হয় নাই। নিজের দেশে থাকলে ড্রাগ ওভারডোজে মারা যেতে না। এখন তোমাকে ড্রাগ ওভারডোজে মারা যেতে হবে! কেমন লাগছে চিন্তা করে?”
লিডিয়া তার মুখটা তিষার একেবারে কাছাকাছি নিয়ে আসে, তিষার কী মনে হল কে জানে হঠাৎ প্রচণ্ড ঘৃণায় থু করে লিডিয়ার মুখে থুতু ফেলল। ঘরে যারা ছিল তারা এতো চমকে উঠল যে সবাই কয়েকমুহূর্ত স্থির হয়ে রইল। তিষাকে যে সিকিউরিটি গার্ড ধরে রেখেছিল, সে খপ করে তার হাত ধরে মোচড় দিতেই তিষা ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে। সিকিউরিটি গার্ড তাকে মারার জন্যে হাত উপরে তুলল, লিডিয়া তাকে থামাল, বলল, “না গায়ে হাত দেবে না। শরীরে মারের বা আঘাতের চিহ্ন থাকতে পারবে না।”
লিডিয়ার চোখ এবং গালে তিষার থুতু ল্যাপটে আছে, সে টেবিল থেকে একটা টিস্যু তুলে তার মুখটা মুছে নেয়। টিসুটার দিকে তাকিয়ে তার মুখটা ঘৃণায় কুঞ্চিত হয়ে যায়। সে মাথা ঘুরিয়ে তিষার দিকে তাকিয়ে হিস হিস করে বলল, “মেয়ে তোমার খুব সৌভাগ্য যে তোমার ড্রাগ ওভারডোজ হয়ে খুব আনন্দের একটা মৃত্যু ঠিক করে রাখা আছে সেটা আর পাল্টানো যাবে না। কিন্তু জেনে রাখ আমি তোমার বাবা মা থেকে শুরু করে তোমার চৌদ্দগুষ্টির সবাইকে টিপে টিপে পোকার মতো মারব!”
ঠিক তখন দরজা খুলে কয়েকজন ঘরে ঢুকল। সবার সামনে সাদা গাউন পরা একজন বয়স্ক মানুষ। হাতে একটা ব্যাগ। ভেতরে ঢুকেই টেবিলে ব্যাগটা রেখে সেখান থেকে একটা সিরিঞ্জ, কয়েকটা এমপুল বের করে সে কাজ শুরু করে দেয়। তাকে দেখে মনে হল এই ঘরে যে অন্য মানুষেরা আছে সেটা সে লক্ষ্য পর্যন্ত করে নি।
বয়স্ক মানুষটির পেছন পেছনে বেশ কয়েকজন মানুষ এসে ঢুকল। তাদের কারো হাতে টেলিভিশন ক্যামেরা কারো হাতে স্ট্যান্ডের উপর লাগানো লাইট, কারো হাতে রিফ্লেক্টর। সবার শেষে দুজন মানুষের হাতে বড় একটা সবুজ রংয়ের পর্দা।
চশমা পরা স্কুল মাস্টারের মতো দেখতে শুকনো একজন লিডিয়াকে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় শুট করব?”
লিডিয়া বলল, “সেটা তোমাদের ব্যাপার। তোমরা ঠিক কর।”
স্কুল মাস্টারের মতো মানুষটি চারিদিকে তাকিয়ে জানালার কাছাকাছি একটা জায়গা দেখিয়ে তার লোকদের বলল, “ক্রমা কীয়ের জন্যে সবুজ স্ক্রিনটা এখানে টানাও।”
মানুষগুলো তখন তখনই কাজে লেগে গেল। স্কুল মাস্টারের মতো মানুষটি তখন অন্য মানুষগুলোকে বলল, “তোমরা লাইটিং শুরু কর। ন্যাচারল লাইটিং হবে, বিকাল বেলা, গাছের ছায়ার কাছাকাছি।”
মানুষগুলো মাথা নেড়ে তাদের ঘাড়ে করে আনা স্টুডিও লাইটগুলো বসাতে শুরু করে।
লিডিয়া জিজ্ঞেস কলল, “কতোক্ষণ লাগবে?”
স্কুলমাস্টার বলল, “খুব বেশী হলে দশ মিনিট।”
লিডিয়া তখন ডাক্তারের মতো মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার?”
মানুষটি বলল, “আমি রেডি।“
লিডিয়া তখন তিষা আর জনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাদের আয়ু আর দশ মিনিট। যা কিছু দেখার আছে দেখে নাও।” কথা শেষ করে লিডিয়া আবার হাসার চেষ্টা করল, হাসতে অনভ্যস্ত তার মুখের মাংশপেশী আবার বিকৃত একটা ভঙ্গীতে কুঞ্চিত হয়ে ওঠে।
ভিডিও ক্যামেরা হাতে মানুষগুলো খুবই দক্ষ, তারা দশ মিনিটের আগেই সবকিছু রেডি করে ফেলল। স্কুল মাস্টার লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা রেডি।”
লিডিয়া তখন তিষা আর জনের দিকে তাকিয়ে জিব দিয়ে সমবেদনার ভঙ্গীতে চুক চুক শব্দ করে বলল, “আমি খুবই দুঃখিত, বেঁচে থাকার জন্যে তোমাদের দশ মিনিট সময়ও দেওয়া গেল না। বুঝতেই পারছ আমাদের তাড়াহুড়ো আছে।” তারপর সিকিউরিটি গার্ডদের বলল, “এদের স্টেজে নিয়ে এস।”
সিকিউরিটি গার্ড ওদেরকে টেনে নিয়ে আসতে থাকে। লিডিয়া স্কুল মাস্টারকে বলল, “মনে রেখো, তোমাদের কিন্তু দ্বিতীয়বার শুট করার সুযোগ নেই।”
স্কুল মাস্টার বলল, “আমি জানি। দ্বিতীয়বারের প্রয়োজন হবে না। মৃত্যু দৃশ্যে অভিনয় সব সময় খুবই খাঁটি হয়।”
কথাটাকে একটা উঁচু দরের রসিকতা বিবেচনা করে ঘরের সবাই শব্দ করে হেসে উঠল।
তিষা আর জনকে যখন স্টুডিও লাইটগুলোর কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়েছে তখন হঠাৎ ঝটকা মেরে নিজেকে মুক্ত করে জন তাকে ধরে রাখা সিকিউরিটি গার্ডের দুই পায়ের মাঝখানে প্রচণ্ড জোরে একটা লাথি মারল, তারপর কেউ কিছু বোঝার আগে সে একটা হিংস্র স্বাপদের মতো লিডিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। লিডিয়া কিংবা ঘরের কেউ এর জন্যে প্রস্তুত ছিল
–লিডিয়া প্রচণ্ড ধাক্কায় হুড়মুড় করে পিছনে পড়ে গেল। টেবিলটা ধরে সে কোনোমতে নিজেকে রক্ষা করতে চাইল কিন্তু পারল না, তার মাথা শব্দ করে মেঝেতে আঘাত করে এবং মুহূর্তের জন্যে তার সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। জন তার বুকের উপর বসে দুই হাতে লিডিয়ার মুখে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকে মুহূর্তের মাঝে লিডিয়ার নাক মুখ রক্তাক্ত হয়ে যায়।