তিষা এক পা এগিয়ে যেতেই সবগুলো এনিম্যান তার থেকে সরে যায়। সে একটা চাপা হাসির শব্দ শুনতে পেল। তিষা জানে এই হাসির শব্দ আসলে প্রকৃত হাসি নয়। এটা তাদের ভয় পাওয়ার প্রতিক্রিয়া। হাসি কান্না দুঃখ ভয় সবকিছুর জন্যেই তাদের একটা মাত্র প্রতিক্রিয়া সেটা হচ্ছে হাসি। এনিম্যানগুলো তাদেরকে দেখে ভয় পেয়েছে।
তিষা নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে একটা এনিম্যানকে ডাকল। এনিম্যানটা একটু সরে গিয়ে কৌতূহল নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তিষা সাবধানে তার হাতটা আরেকটু এগিয়ে নিয়ে এনিম্যানটাকে আস্তে আস্তে স্পর্শ করে। এনিম্যানটাও তখন খুব সাবধানে তিষার হাতটা স্পর্শ করল। তিষা হাসি হাসি মুখে এনিম্যানটাকে নিজের কাছে ডাকল, তখন এনিম্যানটা খুব সতর্ক ভাবে তিষার কাছে এগিয়ে আসে।
তিষা তাকে সাবধানে কোলে তুলে নেয়, তারপর আদর করে তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। এনিম্যান শিশুটি এই আদরটুকু বুঝতে পারল এবং হঠাৎ করে তার ভেতরে তিষাকে নিয়ে যে দ্বিধা বা সংকোচ ছিল তার সবটুকু দূর হয়ে গেল। এনিম্যান শিশুটি তখন তিষার গলা জড়িয়ে ধরে তাকে গভীর ভাবে আলিঙ্গন করে। তিষা হঠাৎ করে বুঝতে পারল তার সামনে এই বিশাল হলঘরের হাজার হাজার এনিম্যান শিশুর সবাই আসলে ভালোবাসার কাঙ্গাল। তাদের জন্যে কেউ কখনো ভালোবাসা দেখায়নি। তাদেরকে কেউ কখনো আদর করেনি। এগুলো মানবশিশু কিন্তু তারা কখনো মানুষের সম্মান, মানুষের মায়া মমতা পায়নি।
একটি একটি করে এনিম্যান শিশুগুলো তখন তিষা আর জনের দিকে হেঁটে আসতে থাকে। তারা সেগুলোকে কোলে নেয় আদর করে। এরা সবাই একটি করে মানব শিশু। একটি মানব শিশুর আসলে বিশাল হলঘরে এভাবে গাদাগাদি করে থাকার কথা নয়। তাদের মায়ের ভালোবাসা নিয়ে বড় হবার কথা। তিষা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে এই শিশুগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। পৃথিবীর মানুষ কেমন করে এতো বড় একটা অবিচারকে মেনে নিল?
তিষা মেঝেতে বসে এনিম্যান শিশুগুলোকে আদর করতে থাকে। তারা ভয়ংকর একটা বিপদে আছে, তাদের কী হবে তারা জানে না, কিন্তু এই মুহূর্তে তিষার আর কিছুই মনে রইল না, সে শুধু মাত্র ভালোবাসার কাঙ্গাল এই মানব শিশুগুলোর দিকে গভীর মমতা নিয়ে তাকিয়ে রইল।
.
লিডিয়া হিংস্র গলায় বলল, “কী বলছ হারিয়ে গেছে?”
কম বয়সী সিস্টেম ম্যানেজার শুকনো মুখে বলল, “ছেলেটা আর মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ক্র্যাগনন সুপার কম্পিউটার যেখানে থাকবে বলে ভবিষ্যৎবাণী করেছে সেখানে নেই। আমাদের সিকিউরিটি তন্ন
তন্ন করে খুঁজছে, ওদের পাওয়া যাচ্ছে না।”
“তোমার সুপার কম্পিউটার ভুল ভবিষ্যত্বাণী করছে?”
“তাইতো দেখছি।” লিডিয়া টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “এটা কীভাবে সম্ভব?”
“বুঝতে পারছি না।” সিস্টেম ম্যানেজার শুকনো গলায় বলল, “আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে।”
“কী সন্দেহ?”
“ক্র্যাগনন সুপার কম্পিউটার এই ছেলেটা আর মেয়েটার সব তথ্য লোড করেছে তাই তারা কখন কী করবে বের করে ফেলতে পারে। কিন্তু তার কাছে এনিম্যানটার কোনো তথ্য নাই। যদি এনিম্যানটা কোনো সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে সুপার কম্পিউটার সেটা সম্পর্কে জানবে না। তাই ভুল ভবিষ্যত্বাণী করবে।”
“তুমি বলতে চাইছ এই ছেলেটা আর মেয়েটা নিজেদের বুদ্ধি দিয়ে চলছে না? একটা এনিম্যানের বুদ্ধি দিয়ে চলছে?”
“আমি সেটাই সন্দেহ করছি।”
লিডিয়া দাঁতে দাঁত চেপে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, “এখন তোমরা কী করছ?”
“পুরানো কায়দায় ছেলেটা আর মেয়েটাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সিসি টিভির ফুটেজ দেখা হচ্ছে। সিকিউরিটির মানুষেরা ঘরে ঘরে গিয়ে খুঁজছে।”
“আমার হাতে সময় নেই। এই ছেলে আর মেয়েটাকে আমার দরকার। এই মুহূর্তে দরকার।”
সিস্টেম ম্যানেজার বলল, “আমরা পেয়ে যাব। নিশ্চয়ই পেয়ে যাব। আমাদের এখানে মানুষ খুব কম। এত বিশাল একটা কম্পাউন্ড এতো অল্প কয়েকজন মানুষ দিয়ে চালানো হয় সেটাই হচ্ছে সমস্যা।”
লিডিয়া কঠিন মুখে বলল, “আমি কোনো কৈফিয়ত শুনতে চাই না। দশ মিনিটের মাঝে আমি এই ছেলে আর মেয়েটাকে চাই।”
সিস্টেম ম্যানেজার নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল।
জন আর তিষাকে খুঁজে বের করতে সিকিউরিটির মানুষগুলোর অবিশ্যি দশ মিনিট থেকে বেশী সময় লাগল না। সিসি ক্যামেরাতে দেখা গেছে তারা দুজন একটা এনিম্যানকে নিয়ে বড় হলঘরের দিকে এগিয়ে গেছে। সিকিউরিটির মানুষেরা হলঘরে গিয়েই তাদের পেয়ে গেল। হাজার হাজার এনিম্যান শিশু ছোটাচ্চুটি করছে, তার মাঝে তিষা আর জন খুব সাবধানে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। এনিম্যান শিশুগুলো প্রথমে তাদের থেকে দূরে দূরে ছিল, কীভাবে বুঝে গেছে তাদেরকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তখন তাদের কাছে এসে ভীড় করেছে। জন আর তিষা হলঘরের শেষ মাথায় যেতে চাইছিল, সেখানে কয়েকটা উঁচু জানালা রয়েছে। এই জানালা দিয়ে বের হওয়া যায় কী না তারা একবার চেষ্টা করে দেখতে চাইছিল কিন্তু তার আর সুযোগ হল না। বড় লোহার গেট খুলে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে পাহাড়ের মতো দুইজন সিকিউরিটি গার্ড হলঘরে ঢুকে গেল।
সাথে সাথে এনিম্যান শিশুগুলো ছোটাচ্চুটি করতে থাকে। আনন্দ বেদনা দুঃখ বা আতংক সবকিছুতেই তাদের প্রতিক্রিয়া এক রকম, তাই তারা খিল খিল করে হাসতেও শুরু করে। ভয়ংকর আতংকে যখন কেউ হাসতে থাকে সেটি অত্যন্ত বিচিত্র একটি দৃশ্য। তিষা আর জন বিশাল হলঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে এনিম্যান শিশুদের এই বিচিত্র প্রতিক্রিয়াটির দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।