লিডিয়া স্থির চোখে রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে রইল, এর আগে কেউ তাকে এতো সোজাসুজি এই কথাগুলো বলেনি। রিকার্ডো হাসার মত ভঙ্গী করে বলল, “তুমি যদি এপসিলনের কোর টিমে যোগ দাও তাহলে হয়তো তুমি বেঁচে যাবে, কারণ আমরা তোমাকে নিরাপত্তা দেব। যদি যোগ না দাও আজ হোক কাল হোক তুমি কোনো একটা ভুল করবে, ধরা পড়বে তারপর বাকী জীবনটা জেলখানায় কাটিয়ে দেবে।”
লিডিয়া এবারেও কোনো কথা বলল না। রিকার্ডো ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মুছে নিচু গলায় বলল, “সাধারণ একজন মানুষ তার জীবনে কী চায়? একটা ভালো চাকরী, ভালো বেতন, একটা পরিবার, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, একটা বাড়ী, গাড়ী এইসব। আবার কিছু মানুষ কী চায়? খ্যাতি। বড় অভিনেতা, গায়ক, ফুটবল প্লেয়ার, লেখক, শিল্পী। আবার কিছু মানুষ কী চায়? নেতৃত্ব। যাদের কথায় অন্য মানুষেরা উঠবে বসবে।”
রিকার্ডো এক মুহূর্ত চুপ করে সোজাসুজি লিডিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর তুমি কিংবা তোমার মত মানুষ কী চায়?”
লিডিয়া শীতল চোখে রিকার্ডোর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর বলল, “তুমিই বল। আমি তোমার মুখ থেকেই শুনি।”
“তোমরা চাও চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তোমরা যে চ্যালেঞ্জ চাও সেই চ্যালেঞ্জ কেউ দিতে পারে না।”
রিকার্ডো বুকে হাত দিয়ে বলল, “আমরা পারি।”
লিডিয়া তার কফির মগে একটা চুমুক দিয়ে বলল, “আমি যদি এপিসিলনে যোগ দিই আমাকে কী করতে হবে?”
“সেটা নির্ভর করবে তোমার ওপরে। তুমি যদি রাজনীতিতে আনন্দ পাও তাহলে আফ্রিকা এশিয়ার দেশগুলোর সরকার পতন করাতে পার। যদি ব্যবসাতে আনন্দ পাও তাহলে পৃথিবীর বড় বড় কোম্পানীকে কেনা বেচা করতে পার। যদি বিজ্ঞানে আনন্দ পাও নূতন কিছু তৈরী করে বাজারজাত করতে পার। এটা পুরোপুরি তোমার ইচ্ছের উপর নির্ভর করে। আমি শুধু বলতে পারি যে বিষয়েই তোমার আগ্রহ থাকুক তুমি সেটা এখানে খুঁজে পাবে।”
“আমি কার সাথে কাজ করব?”
রিকার্ডো হাত নেড়ে পুরো বিষয়টা উড়িয়ে দিল, বলল, “ডিটেলস। তুমি নিশ্চিত থাক এগুলো কোনো সমস্যা নয়। যে যেভাবে কাজ করতে চায় সে সেভাবে কাজ করবে। তোমাকে আমাদের সাথে তাল মিলাতে হবে না। আমরা তোমাদের সাথে তাল মিলাব।”
লিডিয়া কোনো কথা বলল না, তার ভেতরে যে শেষ প্রশ্নটি ছিল রিকার্ডো নামের মানুষটা নিজেই তার উত্তর দিল, বলল, “আমরা কখনো কারো সাথে বেতন নিয়ে কোনো কথা বলিনি কারণ সেটা ইস্যু না। তোমাকে যে প্লাস্টিকের কার্ডটা দিয়েছি সেটা একটা ক্রেডিট কার্ড। তুমি যত ইচ্ছা টাকা খরচ করতে পার।”
“যত ইচ্ছা?”
“হ্যাঁ। যত ইচ্ছা। আমার কথা বিশ্বাস না করলে এখান থেকে বের হয়ে বি.এম. ডব্লিউয়ের শো রুমে গিয়ে একটা গাড়ী কিনে দেখতে পার।”
লিডিয়ার মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠল, সে হাসতে অভ্যস্ত নয় তাই তার হাসিটিতে কোনো আনন্দের চিহ্ন নেই। লিডিয়া প্লাস্টিকের কার্ডটা হাতে নিয়ে সেটাকে উল্টে পাল্টে দেখে আবার টেবিলে রেখে দিল।
রিকার্ডো বলল, “আমি চাই তুমি একটা গাড়ী কিনো। তাহলে বুঝব তুমি এপসিলনে যোগ দেবে বলে ঠিক করেছ।”
লিডিয়া বলল, “তুমি যা যা বলতে এসেছ তার সবকিছু কী বলে ফেলেছ?”
“না। দুটি জিনিষ এখনো বলা হয়নি।”
“কোন দুটি জিনিষ?”
“যিনি এপসিলনকে গড়ে তুলেছেন তার কথা বলা হয়নি। খুব বেশী মানুষ তাকে দেখেনি। তিনি কিন্তু সবাইকে দেখেন। এপসিলনে তুমি যদি যোগ দাও আর তুমি যদি খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পার তিনি হয়তো সরাসরি তোমার সাথে দেখা করবেন। তার সাথে হয়তো তোমার দেখা হবে।”
লিডিয়াটা জিজ্ঞেস করল, “আর দ্বিতীয়টি।”
“দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, এপসিলন কিন্তু একমুখী রাস্তা। তুমি এখানে যোগ দিতে পারবে কিন্তু কখনো এপসিলন ছেড়ে যেতে পারবে না।”
“ছেড়ে যেতে পারব না?”
“না।” এই প্রথম রিকার্ডোর মুখটা কঠিন হয়ে যায়, প্রায় শোনা যায় এরকম গলায় বলল, “কেউ যে কখনো ছেড়ে যায়নি তা নয়। ছেড়ে গিয়েছে। তারা এপসিলন আর পৃথিবী এক সাথে ছেড়ে গিয়েছে।”
লিডিয়া কয়েক মুহূর্ত রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে রইল তারপর তার হাতের প্লাস্টিকের কার্ডটি রিকার্ডোর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমি এপসিলনে যোগ দিতে চাই না।”
রিকার্ডো হা হা করে হেসে উঠল, বলল, “যোগ দিতে না চাইলে দিও। কিন্তু কার্ডটা রেখে দাও। কাজে লাগবে। তা ছাড়া–”
“তাছাড়া কী?”
“আমরা যখন কাউকে আমাদের কার্ড দিই আমরা সেটা আর ফিরিয়ে নিই না।”
“তার মানে—”
রিকার্ডো হাত তুলে লিডিয়াকে থামাল। বলল, “তোমাকে মুখ ফুটে কিছু বলতে হবে না। সাধারণ মানুষেরা মুখ ফুটে কথা বলে। তোমার আমার মত মানুষের মুখ ফুটে কথা বলতে হয় না। কথা না বলেই আমার তথ্য আদান প্রদান করতে পারি।” রিকার্ডো লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। কথা না বলে তথ্য আদান প্রদান বলতে কী বোঝানো হয় বিষয়টা হঠাৎ করে লিডিয়া বুঝতে শুরু করে।
০২. স্কুল বাস থেকে নেমে তিষা
স্কুল বাস থেকে নেমে তিষা আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে ধূসর এক ধরণের মেঘ, এটা মেঘ না কুয়াশা ভালো করে বোঝা যায় না। মাঝে মাঝে যখন ঝির ঝির করে বৃষ্টি শুরু হয় তখন বোঝা যায় যে এটা কুয়াশা না, এটা মেঘ। তিষার হঠাৎ করে দেশের কথা মনে পড়ল। আকাশ কালো করে কুচকুচে মেঘে হঠাৎ করে চারদিক অন্ধকার হয়ে যেতো, বিজলীর ঝলকে সবকিছু কেমন যেন ঝলসে ঝলসে উঠতো, সাথে সাথে কী গম্ভীর গুড় গুড় করে মেঘের ডাক। তারপর বৃষ্টি আর বৃষ্টি। মনে হতো সারা পৃথিবী বুঝি ভাসিয়ে নেবে। সেই বৃষ্টিতে ভিজতে কী মজা–সবাই মিলে তারা বাইরে নেমে যেতো! আর এখানে সবকিছু অন্যরকম। ধোয়ার মত এক ধরনের বৃষ্টি, ঠাণ্ডা, প্যাঁচপ্যাঁচে মন খারাপ করা বৃষ্টি।