“কী স্পেশাল কাজ?”
“আমার আম্মু তার গাড়ী নিয়ে আটকা পড়েছে, আমি তোমাকে আমায় বাসায় নামিয়ে দেওয়ার একটা সুযোগ দেব।”
জন হা হা করে হেসে কুর্নিস করার ভঙ্গী করে মাথা নিচু করে বলল, “প্রিন্সেস তিষা! আপনাকে বাসায় নামিয়ে দেবার জন্যে আমি দশ ডলার কেন দশ হাজার ডলার দিতে প্রস্তুত।”
তিশা বলল, “আজকে স্পেশাল সেল, তাই তোমার জন্যে ফ্রী! চল।”
একটু পরেই দেখা গেল জনের বিশাল গাড়ীতে জনের পাশে বসে তিষা তার বাসায় রওনা দিয়েছে। জন কয়েক মিনিট গাড়ী চালিয়েই তার ভ্রূ কুঁচকে একটা গালি সূচক শব্দ উচ্চারণ করল। তিষা বলল, “কী হয়েছে?”
জন কানে শুনতে পায় না, মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের ভঙ্গী দেখে কথা বুঝতে পারে তাই সে তিষার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না। জন গাড়ীর গতি হঠাৎ করে বাড়িয়ে দিয়ে আবার হঠাৎ করে কমিয়ে এনে কিছু একটা পরীক্ষা করল। তিষা জনের কাঁধ স্পর্শ করতেই সে ঘুরে তিষার দিকে তাকাল। তিষা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
জন স্টিয়ারিং ধরে রেখেছে বলে সাইন ল্যাংগুয়েজে না বলে তার নিজস্ব অস্পষ্ট উচ্চারণে বলল, “কিছু একটা গোলমাল লাগছে। গাড়ীটা ঠিক ব্যবহার করছে না।”
তিষা হেসে ফেলল, বলল, “গাড়ী কী মানুষ নাকী! গাড়ী আবার ঠিক আর ভুল ব্যবহার করবে কেমন করে?”
জন বলল, “মানুষকে কেউ বিশ্বাস করে না। গাড়ীকে করতে হয়।”
জন দক্ষ হাতে গাড়ীটা চালিয়ে নিতে থাকে। তাদের স্কুলটা ছোটখাটো একটা উপত্যকার মাঝে, শহরে যেতে হলে আঁকাবাঁকা একটা রাস্তা দিয়ে পাহাড়ী একটা এলাকায় উঠতে হয়। সেখান থেকে ঢালু বেয়ে নিচে নেমে একটা খাড়া পাথরের ঢালের পাশে দিয়ে যেতে হয়। জায়গাটা একটু বিপদজনক তবে জনের জন্যে এটি কোনো সমস্যা নয়। এই পথে সে
এতোবার গাড়ী চালিয়েছে যে সে আক্ষরিক অর্থেই চোখ বন্ধ করে এখানে গাড়ী চালিয়ে যেতে পারে।
পাহাড়ের উপর থেকে নিচে নামার সময় হঠাৎ জন চিৎকার করে একটা গালি দিল, গলার স্বরে কিছু একটা ছিল, তিষা চমকে উঠে বলল, “কী হয়েছে?”
“ব্রেক ফেল করেছে।”
তিষা আতংকিত হয়ে দেখে জন বারবার ব্রেক প্যাডেলে চাপ দিচ্ছে আর প্রতিবার প্যাডেল একেবারে নিচে নেমে যাচ্ছে কিন্তু গাড়ী থামছে না, ব্রেক একেবারেই কাজ করছে না।
পাহাড়ী ঢালু বেয়ে নামতে নামতে গাড়ীর বেগ বেড়ে যাচ্ছে জন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তার মাঝে হঠাৎ ইঞ্জিনের শব্দ বেড়ে গেল–শুধু যে ব্রেক কাজ করছে না, গাড়ীর ইঞ্জিন দ্বিগুণ শক্তিতে কাজ করছে। গাড়ী সোজা ছুটে যাচ্ছে, কয়েক সেকেন্ডের মাঝে খাড়া ঢালটায় এসে রাস্তার পাশের হালকা রেলিংয়ে ধাক্কা খেয়ে কয়েকশ ফুট নিচে পাথরের উপর ছিটকে পড়বে। পৃথিবীর কোনো শক্তি এখন তাদের থামাতে পারবে না।
জন হঠাৎ আশ্চর্য রকম শান্ত হয়ে গেল। স্টিয়ারিং হুইলটা শক্ত করে তার বিচিত্র যান্ত্রিক উচ্চারণে বলল, “তিষা।”
“হ্যাঁ।”
“হ্যান্ডব্রেকটা দুই হাত দিয়ে ধর।”
তিষা কাঁপা হাতে হ্যাঁন্ড ব্রেকটা দুই হাতে ধরল।
জন শান্ত গলায় বলল, “যখন আমি বলব তখন সমস্ত শক্তি দিয়ে ব্রেকটা টানবে।”
“ঠিক আছে।”
“যদি গাড়ী থামাতে না পারি দুজনেই মরে যাব।”
তিষা কোনো কথা বলল না। জন বলল, “আমি দুঃখিত তিষা। আমি খুব দুঃখিত। এটা হওয়ার কথা ছিল না।”
তিষা কোনো কথা না বলে সমস্ত শক্তি দিয়ে হ্যাঁন্ড ব্রেকটা ধরে রাখল, জন যখন বলবে সে টেনে ধরবে।
খাড়া ঢালটাতে নেমে রেলিংটাতে প্রচণ্ড বেগে আঘাত করার পূর্ব মুহূর্তে জন সমস্ত শক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে স্টিয়ারিং হুইল পুরোটা ঘুরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলল, “এখন।”
গাড়ীটা ঘুরছে, কোন দিকে ঘুরছে সে জানে না, বিকট ঘর্ষণের শব্দ হচ্ছে তার সাথে টায়ার পোড়া গন্ধ, ধোঁয়ায় গাড়ী ভরে গেল। সিট বেল্ট তার বুকের উপর পাথরের মতো চেপে বসেছে, তার মনে হল তবু বুঝি সে ছিটকে বের হয়ে যাবে, সে সবকিছু ভুলে হ্যাঁন্ড ব্রেকটা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে টেনে ধরল।
তারপর কী হল সে জানে না। গাড়ীটা কয় পাক ঘুরেছে সেটাও জানে।, কোথায় ধাক্কা খেয়েছে তাও জানে না, কিন্তু হঠাৎ করে টের পেল গাড়ীটা থেমে গেছে। জন তার বিচিত্র উচ্চারণে জিজ্ঞেস করল, “তুমি ঠিক আছ?”
তিশা বলল, “মনে হয়।”
“তাহলে নেমে যাও।”
তিষা পোড়া একটা গন্ধ টের পেলো কোথা থেকে জানি ধুয়া বের হচ্ছে। হাত দিয়ে দরজার হ্যাঁন্ডেলটা টান দিয়ে সে দরজা খুলে বের হয়ে এল। কপালের কাছে হাত দিতেই ভিজে চটচটে একটা অনুভূতি হল। হাত চোখের সামনে এনে দেখে রক্ত, কপালের কাছে কোথাও কেটে গেছে।
গাড়ীর অন্য পাশ থেকে জন নেমে আসে, তার নাক থেকে রক্ত বের হচ্ছে। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তিষার কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে বলল, “আমরা বেঁচে গেছি।”
তিষা ফিস ফিস করে বলল, “থ্যাংকু জন। শুধু মাত্র তোমার জন্যে বেঁচে গেছি।” রাস্তার পাশে তখন বেশ কয়েকটা গাড়ী এসে থেমেছে, সেখান থেকে লোকজন নেমে তাদের দিকে ছুটে আসতে থাকে। এতক্ষণ তারা দুই পায়ের উপর দাঁড়িয়েছিল হঠাৎ করে বিচিত্র এক ধরনের ক্লান্তি এসে তাদের উপর ভর করে। প্রথমে তিষা তারপর জন রাস্তার পাশে এসে বসে পড়ল। তিষা জনের ঘাড়ে মাথা রেখে ফিস ফিস করে বলল, “কী হয়েছিল জন?”