জনের সাথে সাথে থেকে তাদের ক্লাশের অনেকেই এখন সাইন। ল্যাংগুয়েজ অনেকখানি বুঝতে পারে, যখন বুঝতে পারে না তখন জন ফিস ফিস করে তার আধা যান্ত্রিক আধা মানবিক গলায় বুঝিয়ে দেয়। এবারে অবশ্যি তার বুঝিয়ে দিতে হল না, জন কী বলতে চেয়েছে তিষা সাইন ল্যাংগুয়েজ থেকে সেটা বুঝে গেল। হেসে বলল, “কোর্সটা ইতিহাসের তাই মিশরীয় সভ্যতার উপর লিখতে হবে। কম্পিউটারের কোর্স হলে কম্পিউটারের উপর লিখতে হত। গাড়ীর কোর্স হলে গাড়ীর উপর লিখতে হত।”
জন হাত দিয়ে বলল, “সরাসরি কেটে এনে রিপোর্টে বসিয়ে দিলে সমস্যা কী? নিজের মতো করে লিখতে হবে কেন? আমি কী গুগল থেকে বেশী জানি?”
তিষা হাসল, বলল, “সেটা ভুল বলনি! কিন্তু গ্রেডটা তো গুগলকে দেয়া হয় না, গ্রেড দেয় তোমাকে!”
জন হতাশার ভঙ্গী করে আবার মনিটরে চোখ দিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে মিশরের ফেরাউন রামেসিসের কাহিনী পড়তে থাকে।
এরকম সময় মিশকা ঘরে এসে ঢুকে, সে কাছে এসে তিষাকে ধরে দুই পায়ে দাঁড়াল। তিষা মিশকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “কী খবর মিশকা? জীবনটা কী রকম মনে হচ্ছে?”
মিশকা ফিক করে হেসে তিষার হাতে হাত বুলিয়ে দেয়। তার ভঙ্গী দেখে মনে হয় সে বুঝি তিষার কথাটা বুঝতে পেরেছে। তিষা বলল, “মিশকা। তুমিই ভালো আছ তোমার মিশরীয় সভ্যতার উপর রিপোর্ট এনিম্যান লিখতে হচ্ছে না!”
মিশকা আবার ফিক করে হেসে উঠল। জন মিশকার দিকে তাকিয়ে থেকে হাত নেড়ে সাইন ল্যাংগুয়েজে বলল, “কী সুন্দর হাসে দেখেছ?”
মিশকা জনের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, মনে হয় সেও বুঝি সাইন ল্যাংগুয়েজ বোঝার চেষ্টা করছে, তারপর জনের কাছে গিয়ে তার পায়ে হাত বুলিয়ে তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। জন আদর করে মিশকার চুল এলোমেলো করে দিয়ে তিষাকে বলল, “আমি কখনো জানতাম না মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণী হাসতে পারে।”
তিষা বলল, “হয়তো এটা মানুষ।”
জন মাথা নাড়ল, বলল, “না। এটা মানুষ না। বৈজ্ঞানিকেরা বলেছে। এর জিনেটিক কোডিং মানুষের থেকে ভিন্ন।”
“কতোটুকু ভিন্ন? তার চেয়ে বড় কথা কতোটুকু ভিন্ন হলে তুমি বলবে এটা মানুষ না?”
জন হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গী করে বলল, “আমি জানি না। আমি এনিম্যান ডিজাইন করি নাই।”
তিষা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিশকার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তা ছাড়া এই যে এর মুখের হাসি, তুমি কী মনে কর এটা সত্যি? হয়তো এটা সত্যি না।”
জন হাত তুলে তিষাকে থামাল, বলল, “দাঁড়াও, দাঁড়াও, মনে আছে তুমি তোমার ব্লগে এটা লিখেছিলে?”
“হ্যাঁ।”
“তারপর অন্যেরা কী লিখেছে দেখ নাই।”
“দেখেছি। অন্যেরা বলেছে এটা ঠিক না, তাদের এনিম্যান কখনো ভয় পায় না, দুঃখ পায় না। বলেছে এনিম্যানের ভয় পাবার, দুঃখ পাবার, মনে কষ্ট পাবার ক্ষমতা নেই।”
“কাজেই কেস ক্লোজড। তুমি এটা নিয়ে মাথা ঘামিও না।”
তিষা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমার কী মনে হয় জান?”
“কী মনে হয়?”
“আমার মনে হয় এই যে অন্যেরা যা লিখেছে সেগুলো আসলে সত্যি না। যারা এনিম্যান তৈরী করেছে তারা চায় না আসল কথাটা বের হয়ে আসুক। তারা সবকিছু গোপন রাখতে চায়।”
জন হা হা করে হাসল, বলল, “তুমি আজকাল মনে হয় খুব বেশী ডিটেকটিভ বই পড়ছ!”
তিষা হাসল না। বলল, “আমার কী মনে হয় জান?”
“কী?”
“আমার মনে হয় আমি যদি কোনোভাবে মিশকার সাথে কথা বলতে পারতাম তাহলে জিজ্ঞেস করতাম, বল দেখি মিশকা তোমার মনে কোনো গোপন দুঃখ আছে কী না!”
জনের মনে হল কথাটা খুব পছন্দ হল, সে আরো জোরে হা হা করে। হাসতে লাগল। মিশকা তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর সেও, খিল খিল করে হাসতে লাগল।
.
দুইদিন পর বিকেল বেলা তিষা স্কুলে তার আম্মুর জন্যে অপেক্ষা করছে তখন তার টেলিফোন বেজে উঠল, তার আম্মুই ফোন করেছেন। তিষা ফোন ধরল, “হ্যালো আম্মু। তুমি কোথায়?”
“আর বলিস না। সেফওয়ে থেকে বাজার করে গাড়ীতে উঠেছি, দেখি গাড়ী কেমন যেন ঘসটে ঘসটে যাচ্ছে আর থপ থপ শব্দ!”
তিষা অবাক হয়ে বলল, “থপ থপ শব্দ?”
“হ্যাঁ, গাড়ী থামিয়ে দেখি সামনের ডান দিকের চাকায় কোনো বাতাস নাই। চাকা পাংচার।”
“এখন?”
“গাড়ী পার্কিং লটে রেখে তোর আব্বুকে ফোন করেছি!”
তিষা হতাশ ভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “এই দেশের ক্লাশ ফাইভের বাচ্চাও গাড়ীর চাকা পালটাতে পারে, আর তুমি এখনো মনে হয় জান না। তোমার গাড়ীর চাকা কয়টা!”
আম্মু বললেন, “ঢং করবি না। আমি মরি নিজের যন্ত্রণায় আর ইনি এসেছেন জ্ঞান দিতে।”
“তুমি যদি চাকা বদলানো শিখে নিতে তাহলে আর নিজের যন্ত্রণায় মরতে হত না। যাই হোক আমি কী করব? তোমার জন্যে অপেক্ষা করব নাকী বাসায় চলে যাব?”
“আমার মনে হয় দেরী হবে। তোর আব্বু সেই বেসমন্ট থেকে আসবে, এসে আমার উপর একটু মেজাজ করবে তারপর চাকা বদলাবে তারপর আবার মেজাজ করবে তারপর পাংচার চাকা ঠিক করতে দিবে মনে হয় কয়েকঘন্টার ধাক্কা। তুই কোনোভাবে চলে যা–”
“ঠিক আছে আম্মু।”
“তুই কীভাবে যাবি?”
“বাসে চলে যাব না হলে কেউ নামিয়ে দেবে। জনের কতো বড় গাড়ী দেখ নাই?”
“ঠিক আছে।”
তিষা জনকে খুঁজে বের করে বলল, “জন। তুমি যদি আমাকে দশ ডলার দাও তাহলে তোমাকে আমি একটা খুবই স্পেশাল কাজ করার সুযোগ দিব।”