রোস্ট বীফের একটা টুকরো মুখে ঢুকিয়ে মানুষটা হঠাৎ শব্দ করে হাসতে শুরু করে। হাসতে হাসতে লিডিয়াকে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, “তোমার ভয় পাবার কিছু নেই। আমি পুলিশ থেকে আসিনি।”
লিডিয়া বলল, “আমি ভয় পাইনি।” কথাটি বলতে গিয়ে লিডিয়া এক ধরণের অপমান অনুভব করে। তার জীবনে সে সবসময় অন্য মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, অন্য মানুষেরা কখনো তার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করেনি। লিডিয়া তার জীবনকে একটা দুর্ভেদ্য দেয়াল দিয়ে আড়াল করে রেখেছে। সে কখনো ভাবেনি কেউ সেই দুর্ভেদ্য দেওয়াল ভেদ করে তার জীবনের ভেতরে উঁকি দিতে পারবে। দেখা যাচ্ছে তার জীবনের ভেতর কেউ না কেউ উঁকি দিয়েছে। মানুষটি যদি তার থিসিস লিখিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটি জানে তাহলে সম্ভবত আরো অনেক কিছু জানে। লিডিয়ার জীবনে অনেক ঘটনা আছে যেগুলো জানাজানি হলে তাকে দীর্ঘ দিন জেলখানায় জীবন কাটাতে হবে।
রিকার্ডো নামের মানুষটি লিডিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা দীর্ঘদিন থেকে তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছি। তুমি তোমার থিসিস জমা দিয়েছ এখন কাজ শুরু করতে পারবে। আমি তোমাকে একটা চাকরী দিতে এসেছি।”
লিডিয়া একটু অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকাল। মানুষটা বেশ তৃপ্তি নিয়ে রোস্ট বীফের টুকরোটা চিবুতে চিবুতে বলল, “আমরা তোমার লেখাপড়ার ক্ষতি করতে চাইনি, তাই আগে আসিনি। এখন এসেছি।”
লিডিয়া তার কফির মগটি টেবিলে রেখে বলল, “তোমরা কারা?”
“বলছি। আগে বলি কেন তোমার কাছে এসেছি।”
লিডিয়া শান্ত মুখে রিকার্ডো নামের মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল।
রিকার্ডো বলল, “বছর তিনেক আগে আফ্রিকার একটা দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। দুর্ভিক্ষের কারণ ছিল জনসংখ্যা। তখন তুমি একটা প্রবন্ধ লিখে সমস্যাটার সমাধান দিয়েছিলে, মনে আছে?”
লিডিয়া কোনো কথা বলল না। কথাটি সত্যি যে জনসংখ্যা এবং দুর্ভিক্ষের সে একটি অত্যন্ত সহজ সমাধান দিয়েছিল। প্রবন্ধটি যে সে লিখেছে সেটি কারো জানার কথা নয়। মানুষকে যে গবাদি পশুর মতো খাবারের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে পৃথিবীর মানুষ সেই সত্যটি গ্রহণ করার জন্যে প্রস্তুত নয়। জনসংখ্যাই হচ্ছে সমস্যা, খাবার হিসেবে ব্যাবহার করে সেই জনসংখ্যাই কমিয়ে দেয়া যায় সেটি কেন কারো চোখে পড়েনি সেটি লিডিয়া কখনো বুঝতে পারেনি। পৃথিবীর মানুষ লিডিয়ার সমাধানটি গ্রহণ করেনি কিন্তু সেটি নিয়ে সারা পৃথিবীতে প্রচণ্ড আলোড়ন হয়েছিল। প্রবন্ধটি কে লিখেছিল সেটি কেউ জানতে পারেনি অন্ত ত লিডিয়া তাই ভেবেছিল। এখন দেখা যাচ্ছে আর কেউ না জানলেও এই মানুষটি জানে।
রিকার্ডো বলল, “তুমি যে পদ্ধতিতে তোমার পরিচয়টি গোপন রেখেছিলে সেটি অসাধারণ। কিন্তু দেখতেই পাচ্ছ আমরা জানি। কীভাবে জানি সেটাও তোমাকে বলতে পারি–আমাদের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করতে হয়েছে। আমাদের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী একটা সুপার কম্পিউটার আছে, সেটা ব্যবহার করে তোমার লেখার স্টাইল শব্দচয়ন বাক্যগঠন এই সবকে প্যারামেট্রাইজ করেছি। তারপর পৃথিবীর সকল প্রকাশিত লেখার সাথে মিলিয়ে দেখেছি। সেখান থেকে শর্ট লিস্ট করে তাদের খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তোমাকে আলাদা করেছি। তুমি জান না, আমরা দুইবার তোমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করেছি। একটু অসাবধান থাকার কারণে দুইবারই তুমি আইনী ঝামেলায় পড়ে যেতে পারতে।”
লিডিয়া প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আবার জিজ্ঞেস করে, “তোমরা কারা?”
মানুষটি পকেট থেকে একটা প্লাস্টিকের কার্ড বের করে টেবিলে রাখে। তারপর একটা টোকা দিয়ে সেটাকে টেবিলের অন্যপাশে লিডিয়ার দিকে পাঠিয়ে দিল। কার্ডের ওপর ছোট করে লেখা এপসিলন। লিডিয়া কখনো এই প্রতিষ্ঠানের নাম শুনেনি।
রিকার্ডো বলল, “এপসিলনের নাম সারা পৃথিবীর খুব বেশী মানুষ জানে না। এপসিলন যেসব কোম্পানীর মালিক, কিংবা পরিচালনা করে তার নাম কিন্তু সবাই জানে। যুদ্ধ জাহাজ থেকে ভাইরাসের প্রতিষেধক সবকিছু আমরা তৈরি করি। সারা পৃথিবীতে আমাদের ব্যবসা। সত্যি কথা বলতে কী রাষ্ট্র নাম দিয়ে আমরা পৃথিবীর মাঝে যে বিভাজন করেছি সেটি আমাদের কাছে হাস্যকর একটি বিভাজন! আমরা রাষ্ট্রের ওপরের স্তর। পৃথিবীর যে কোনো রাষ্ট্রকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। ছোটখাটো রাষ্ট্রের পরিবর্তন করতে চাইলে আমরা এক সপ্তাহে করতে পারি। খুব বড় রাষ্ট্র হলে বছরখানেক লাগতে পারে।”
“তুমি আমাকে এসব কেন বলছ?”
“তোমাকে দলে টানার জন্যে!”
“তাতে তোমাদের লাভ?”
“আমরা আমাদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছি তোমাদের মত কিছু মানুষ দিয়ে।”
লিড়িয়া ভুরু কুঁচকালো, “আমাদের মত?”
রিকার্ডো মুখে আরেকটা বড় রোস্ট বীফের টুকরো ঢুকিয়ে খুব তৃপ্তির সাথে চিবুতে চিবুতে গলা নামিয়ে বলল, “হ্যাঁ। তোমাদের মত মানুষ। যাদের অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, যারা অসম্ভব সৃজনশীল, যাদের উচ্চাকাংখার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। কিন্তু যাদের ভেতর কোনো মানবতা নেই তাদেরকে কেউ থামিয়ে রাখতে পারে না। কারণ তাদের ভেতর বিবেক বলে কিছু নেই। তারা বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ ছাড়া যে কোনো ধরণের অন্যায় করতে পারে! তুমি হচ্ছ সেরকম একজন মানুষ।”