তিষা জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাল, বলল, “এই দেশে আমি কখনো আকাশে মেঘ জমতে দেখি নি! বিদ্যুৎ তো অনেক দূরের ব্যাপার।”
আম্মু বললেন, “আজকে খবরে বলেছে রাতে বজ্রপাতসহ ঝড় হবে!”
তিষা হাত তালি দিয়ে বলল, “সত্যি হবে তো? কতোদিন বিজলী মেঘ এসব দেখি না! মনে আছে বাংলাদেশে কালবৈশাখীর সময় কী চমৎকার ঝড় হতো? কুচকুচে কালো মেঘ আর তার মাঝে ঝিলিক করে বিজলী তারপরে মেঘের ডাক! মনে আছে?”
আম্মু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “মনে নেই আবার! দেশের মেঘ বৃষ্টি খুবই মিস করি।”
.
রাত্রে তিষা তার বিছানায় বসে কোলের মাঝে ল্যাপটপ রেখে কাজ করছে। ঘরের এক কোনায় একটা কার্ডবোর্ডের বাক্সে একটা কম্বল ভাঁজ করে তার মাঝে মিশকার শোওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঠিক ছোট শিশুর মত পা গুটিয়ে সে ঘুমিয়ে আছে।
তিষা তার প্রিয় একটা গান ডাউনলোড করে যখন সেটা শুনতে যাচ্ছে ঠিক তখন আকাশে গুড়গুড় করে মেঘ ডাকল, ঠিক যেভাবে দেশে মেঘ ডাকতো। তিষা জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়, আকাশ চিরে একবার বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল তারপর হঠাৎ করে প্রচণ্ড শব্দে আশেপাশে কোথাও বাজ পড়ল।
তিষা চমকে উঠল আর ঠিক তখন খুব বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটল। মিশকা চমকে ঘুম থেকে জেগে উঠল, আতংকে চিৎকার করার ফলে সেটি খুব জোরে শব্দ করে হেসে উঠল তারপর অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মত হাসতে হাসতে সেটি তার বাক্স থেকে লাফ দিয়ে বের হয়ে প্রায় ছুটে এসে তিষার বিছানায় উঠে তিষাকে জড়িয়ে ধরে খিল খিল করে হাসতে থাকে। তিষা অবাক হয়ে লক্ষ্য করল সেটি থরথর করে কাঁপছে।
তিষা এনিম্যানটাকে জড়িয়ে ধরে তার মাথায়, শরীরে হাত বুলিয়ে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বজ্রপাতের বিকট শব্দে এটি ভয় পেয়েছে। ভয় পেয়ে এটি আতংকে চিৎকার না করে শব্দ করে হেসে উঠছে। যখন কাদার কথা তখন হাসছে!
হঠাৎ করে তিষার একটা বিচিত্র কথা মনে হল, হয়তো এই এনিম্যানটি আসলে ভয় পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। কিন্তু যারা তাকে তৈরী করেছে তারা এনিম্যানের কাদার ক্ষমতা দেয়নি তাই যখন কাঁদার কথা তখন সেটি হাসছে। আসলে হয়তো এটি হাসি নয় আসলে এটি কান্না। এই এনিম্যানটি হয়তো আসলে হাসিখুশী একটা প্রাণী নয়, এনিম্যানটি হয়তো আসলে খুব দুঃখী একটা প্রাণী। এটা তার দুঃখটাকে প্রকাশ করে হাসি দিয়ে! তিষা নিজের অজান্তেই কেমন জানি শিউরে উঠল।
এনিম্যানটি কিছুক্ষণেই শান্ত হয়ে যায়। তার মাথায় শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে তিষা আবার তাকে তার কার্ডবোর্ডের বাক্সে শুইয়ে দিয়ে ল্যাপটপটা কোলে তুলে নেয়। বাহিরে যখন ঝড় শুরু হয়েছে বাতাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে তখন সে তার ব্লগে লিখল।
“এনিম্যান কী সত্যি খুব হাসি খুশী প্রাণী? এমনকী হতে পারে না যে আসলে এটি খুব দুঃখী একটা প্রাণী? তার ভেতর অনেক কষ্ট কিন্তু সে তার কষ্টটা প্রকাশ করে হাসির মতো একটা ভঙ্গী করে। তাই আমরা ভাবি এটি খুব হাসিখুশী। আসলে এটি হাসিখুশী নয়। আসলে এটি ভীত আতংকিত একটা প্রাণী?
আমি শুধু শুধু এটি বলছি না। একটু আগে বিকট শব্দে একটা বজ্রপাত হল। ভয়ে চমকে জেগে উঠে আমার এনিম্যানটি আতংকে চিৎকার না করে জোরে হেসে উঠল। ছুটতে ছুটতে আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে এটা ভয়ে থর থর করে কাঁপছিল। কিন্তু তার মুখে ভয় নেই, তার মুখে হাসি।
কি বিচিত্র!”
তিষা জানতেও পারল না ব্লগে তার এই সহজ কয়েক লাইনের লেখাটি কী ভয়ংকর একটি প্রক্রিয়া শুরু করে দিল।
০৯. উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী তার টেবিলে
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী তার টেবিলে আঙুল দিয়ে ঠোকা দিতে দিতে বলল, “ব্লগের লেখাটা পড়েছ?”
লিডিয়া মাথা নাড়ল, বলল, “পড়েছি। এনিম্যানকে নিয়ে যত লেখা বের হয় তার সব কিছু সিস্টেম পাঠানো হয়। আমাদের সুপার কম্পিউটার ক্র্যাগনন সেটা বিশ্লেষণ করে রিপোর্ট পাঠায়।”
“আমি জানি।” উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী বলল, “যখন গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয় সেটা আমাকেও জানানো হয়। এটা আমাকে জানানো হয়েছে, আমি ব্লগটা পড়েছি। ব্লগটা লিখেছে পনেরো বছরের একটা মেয়ে। নাম তিষা আহমেদ।”
লিডিয়া মাথা নাড়ল, “মেয়েটার সব খোঁজ খবর নেয়া হয়েছে।”
“এখন কী করবে?”
“সবচেয়ে সহজ সমাধান হচ্ছে মেয়েটাকে মেরে ফেলা। কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“এই মেয়েটা সাধারণ একটা মেয়ে না। তার এলাকায় সে ছোটখাটো সেলিব্রেটি। সাসকুয়ান হ্রদের উপরে বরফের আস্তরণ ভেঙ্গে নিচে পড়ে গিয়ে অক্সিজেন ছাড়া সাতাইশ মিনিট ছিল। মেয়েটা বেঁচে গেছে, ব্রেনের কোনো ক্ষতি হয়নি। লোকাল নিউজে তাকে অনেকবার দেখিয়েছে। ন্যাশনাল নিউজেও এসেছে। স্কুলে সে অসম্ভব পপুলার।”
“তার মানে কী দাঁড়াল?”
লিডিয়া বলল, “এখন তাকে হুট করে মেরে ফেলা যাবে না। খুব সাবধানে মারতে হবে যেন কেউ কোনো রকম সন্দেহ করতে না পারে।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী কোনো কথা না বলে লিডিয়ার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, হঠাৎ করে লিডিয়া এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। সে শুকনো গলায় বলল, “এরকম কিছু হতে পারে আমরা কখনো ভাবিনি।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী এবারেও কোনো কথা বলল না, লিডিয়া বলল, “আমরা ব্যাপারটা সামলে নেব। এই মেয়েটা যে কথা লিখেছে তার বিপরীতে অসংখ্য ব্লগ লেখা হচ্ছে। আমরা মোটামুটিভাবে সবাইকে বুঝিয়ে দেব লেখাটি সত্যি নয়।