আম্মু ঠিক তখন এক গ্লাস দুধ নিয়ে এসেছেন, সেটা দেখেই তিষা মুখ ভার করে বলল, “আম্মু তুমি আবার দুধ নিয়ে এসেছ!”
“খেয়ে নে বাবা, তোর ডাক্তার বলে দিয়েছে খুব ভালো করে খেতে হবে।”
“কখনো বলেনি আম্মু। এই দেশের ডাক্তাররা কখনো খেতে বলে না, বরং উল্টোটা বলে। কম করে খেতে বলে।”
“এই এক গ্লাস দুধ।”
তিষা নাক কুঁচকে বলল, “খাওয়া উচিৎ তোমার আম্মু! তুমি কতো শুকিয়েছ সেটা দেখেছ?”
তিষার কথা বলার ভঙ্গীর কারণেই হোক আর অন্য কারণেই হোক এনিম্যানটি মনে হয় খুব মজা পেল, সেটা হঠাৎ খিলখিল করে শব্দ করে হাসতে থাকে। তিষা তার দিকে চোখ পাকিয়ে বলল, “কী হল? তুমি এভাবে হাসছ কেন?”
এনিম্যানটি মনে হয় এই কথায় আরো বেশী মজা পেয়ে গেল। সেটা আরো জোরে হাসতে থাকে। আম্মু বললেন, “কী মজার একটা জিনিষ! শুধু হাসে।”
“হ্যাঁ আম্মু, অসম্ভব হাসিখুশী। পৃথিবীর সব মানুষ যদি এদের মত হতো তাহলে কতো মজা হতো!”
“দেখে মনে হয় খুব লক্ষ্মী।”
“হ্যাঁ আম্মু খুব লক্ষ্মী।”
“কী নাম দিবি ঠিক করেছিস?”
“এতো লক্ষ্মী তাই ভেবেছিলাম লক্ষ্মী বলেই ডাকব। কিন্তু তাহলে আমার এদেশের বন্ধুরা নাম উচ্চারণই করতে পারবে না। দাঁত টাত ভেঙ্গে যাবে। তাই ঠিক করেছি মিশকা নাম দিয়ে ডাকব।”
“মিশকা?”
“হ্যাঁ। মিশ-কা।” তিষা তখন এনিম্যানটার দিকে তাকিয়ে বলল, “বুঝলে? এখন থেকে তোমার নাম মিশকা মিশ-কা।”
এনিম্যানটি কী বুঝল কে জানে, কিন্তু ঠিক মানুষের মত মাথা নাড়ল।
তিষা দুধ শেষ না করা পর্যন্ত আম্মু দাঁড়িয়ে রইলেন তারপর খালি গ্লাসটা নিয়ে নিচে চলে গেলেন। ঠিক এরকম সময় বাসার সামনে একটা গাড়ী থামার শব্দ হল। প্রায় সাথে সাথেই গাড়ীর দরজা খুলে কয়েকজনের গাড়ী থেকে হৈ হুল্লোড় করে নামার শব্দ হল। তিষা জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল এবং সাথে সাথে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। তার ক্লাশের বেশ কয়েকজন ছেলে মেয়ে এসেছে। গাড়ীর ড্রাইভিং সিট থেকে জন নেমে আসছে–এতো বড় একটা গাড়ী জন কোথায় পেয়েছে কে জানে?
তিষা এনিম্যানটাকে কোল থেকে নিচে নামিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে। ততক্ষণে সবাই বাসার ভেতরে ঢুকে গেছে। তিষার, আম্মু দরজা খুলে তাদেরকে বাসার ভিতরে নিয়ে এসেছেন। তিষাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আসতে গিয়ে এদের অনেককেই তিষার আম্মু চিনেন। একজন একজন করে সবাই তিষার আম্মুকে আলিঙ্গন করল। মেয়েরা আম্মুকে চুমু খেল।
তিষাকে দেখে সবাই চিৎকার করে হাসল, বলল, “টিশা! তোমাকে অসাধারণ দেখাচ্ছে!”
তিশা বলল, “আমি তোমাদের কতোবার বলব আমার নাম টিশা না, আমার নাম তিষা!”
লিজা নামের একজন মেয়ে বলল, “ তোমার কথাবার্তা খুবই আজব। আমরা তো টিশাই বলছি!”
জন তার হাত নেড়ে সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে বলল, “শুধু আমি ঠিক করে উচ্চারণ করি। তাই না?”
জনের কথা শুনে কিংবা দেখে সবাই হেসে উঠল এবং তিষা সাথে সাথে মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক বলেছ!”
তিষা জনকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এই গাড়ী কোথায় পেয়েছ জন?”
“কিনেছি! মনে নেই গত সামারে ক্রীতদাসের মতো খাটলাম? সেই ক্রীতদাসের বেতন দিয়ে কিনেছি।”
তিষা চোখ কপালে তুলে বলল, “সত্যি?”
লিজা বলল, “সে জন্যেই তো তোমাকে নিতে এসেছি! জন তার নূতন গাড়ীতে চড়িয়ে আমাদের আইসক্রিম পার্লার নিয়ে যাবে!”
তিষা আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আম্মু আমি যাই?”
“যাবি? যা।”
এই স্টেটে মাত্র পনেরো বছর বয়সেই গাড়ী চালানোর নিয়ম আছে ষোল বছরে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়ে দেয়। এতো অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা গাড়ী চালাবে আম্মু খানিকটা অস্বস্তি বোধ করেন কিন্তু সেটা প্রকাশ করলেন না। বললেন, “সাবধানে গাড়ী চালিও।”
তিষা বলল, “তুমি কোনো চিন্তা করো না আম্মু, জন হচ্ছে সুপার ড্রাইভার!”
বসার ঘরে হইচই শুনে এনিম্যানটি সতর্ক পায়ে নিচে নেমে এসেছে। তাকে দেখে সবাই আবার আনন্দে চিৎকার করতে থাকে! জন কাছে গিয়ে সেটাকে কোলে তুলে নেয় আর সাথে সাথে সেটা ফিক করে হেসে ফেলে। একজন একজন করে সবাই এনিম্যানটিকে আদর করল, তারপর তিষাকে নিয়ে বের হয়ে গেল। আম্মু জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন সবাই জনের বিশাল গাড়ীটিতে গিয়ে উঠেছে, এতো কম বয়সী ছেলে এতো বড় একটা গাড়ী কেমন করে কিনে ফেলল কে জানে! হয়তো এই দেশে বড় গাড়ীই সস্তা, কে বলতে পারবে?
তিষা যখন ফিরে এসেছে তখন আকাশে কালো করে মেঘ জমতে শুরু করেছে। আম্মু স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “যাক বাবা! ঠিক ঠিক চলে এসেছিস। যা দুশ্চিন্তা লাগছিল!”
তিষা অবাক হয়ে বলল, “সে কী! তোমার দুশ্চিন্তা কী নিয়ে?”
“বাচ্চা একটা ছেলে সবাইকে নিয়ে গাড়ী চালাচ্ছে, দুশ্চিন্তা করব না?”
“আম্মু, তুমি আমেরিকানদের চিনো না! এরা গাড়ী ছাড়া আর কিছু বুঝে না। জন গাড়ীর পুরো ইঞ্জিন খুলে আবার লাগিয়ে দিতে পারে। সে হচ্ছে গাড়ীর পোকা!”
“আমি ভেবেছিলাম সে কম্পিউটারের পোকা।”
“কম্পিউটারের জিনিয়াস আর গাড়ীর পোকা।”
“দুটোর মাঝে পার্থক্য কী?”
“একটা হয় মাথা দিয়ে অন্যটা অভ্যাস দিয়ে!”
আম্মু হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গী করে মাথা নাড়লেন আর ঠিক তখন বাইরে বিদ্যুতের আলো ঝলসে উঠল। আম্মু বললেন, দেখেছিস! বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে!”