সাথে সাথে আম্মু চোখ খুলে তাকালেন। নার্স তার ঘাড়ে হাত রেখে নরম গলায় বলল, “তোমার মেয়ে জেগে উঠে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।”
আম্মুর মুখ দেখে মনে হল আম্মু বুঝি কথাটা বুঝতে পারেন নি, কিন্তু তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। খুব ধীরে ধীরে আম্মু উঠে দাঁড়ালেন, হঠাৎ করে তাঁকে দেখে মনে হল তার শরীরে বুঝি কোনো শক্তি নেই। নার্সের হাত ধরে আম্মু যখন ওয়েটিং রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন তখন শিশুকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকা মহিলাটি বলল, “এই যে, তুমি শুনো।”
আম্মু ঘুরে তার দিকে তাকালেন, মহিলাটি তার ঘুমন্ত বাচ্চাটিকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে বলল, “তুমি এভাবে তোমার মেয়ের কাছে যেতে পারবে না। তিন মাস কোমায় থেকে জেগে উঠে তোমাকে এভাবে দেখলে তোমার মেয়ে আবার কোমায় চলে যাবে।”
আম্মু অবাক হয়ে মহিলাটির দিকে তাকালেন, মহিলাটি বলল, “তোমাকে দেখে বোঝা যায় তুমি তিন মাস আয়নার সামনে যাও নাই। তুমি একজন সুন্দরী মহিলা, তোমার চেহারার কী অবস্থা করেছ তুমি জান না! দাঁড়াও, তুমি চুল আঁচড়াও, ঠোঁটে লিপস্টিক দাও। তোমার দরকার ডার্ক শ্যাডো–আমারটা দিয়ে কাজ চলে যাবে! নাও লিপস্টিক দাও, তোমার ভয় নাই, আমার কোনো সংক্রামক রোগ নাই।”
মহিলাটি আম্মুর চুল খুলে আঁচড়ে দিল, ঠোঁটে লিপস্টিক দিল, গালে পাউডার দিল তারপর বুকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।
.
তিষা তার আম্মুকে দেখে বলল, “আম্মু তোমার কী হয়েছে? তুমি এত শুকিয়ে গেছ কেন?”
আম্মু বললেন, “আমার কিছু হয়নি মা। আমি খুব ভালো আছি। সারা পৃথিবীতে আমার থেকে ভালো কেউ নেই।”
“আমার কী হয়েছে আম্মু? আমি হাসপাতালে কেন?” “সেটা অনেক বড় একটা কাহিনী মা। তোকে বলব।”
“আজকে কী বার আম্মু? বৃহস্পতিবার আমার মায়া সভ্যতার উপর একটা রিপোর্ট জমা দেবার কথা ছিল।”
আম্মু হেসে ফেললেন, বললেন “তুই রিপোর্ট লেখার অনেক সময় পাবি মা। আজকে কী বার সেটা তো আমিও জানি না!”
.
সন্ধেবেলা তিষা তার ঘরে টেলিভিশনে স্থানীয় খবরে নিজেকে দেখতে পেল। স্থানীয় সংবাদদাতা বলল, “গত ২৪ জানুয়ারী সাসকুয়ান হদে বরফের আস্তরণ ভেঙ্গে টিশা আমেদ (আমেরিকান সংবাদদাতা তিষা আহমেদ নামটা এর চাইতে ভালো করে উচ্চারণ করতে পারে না!) নামে কাউন্টি জুনিয়র স্কুলের ছাত্রী হিম শীতল পানিতে ডুবে যায়। বরফের নিচ থেকে তার পোষা কুকুর টুইটি টিশা আমেদের দেহ উদ্ধার করে আনে। ততক্ষণে তার দেহ হাইপোথারমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গেছে। মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় রক্ত সঞ্চালিত না হওয়ায় সে কোমাতে চলে যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সমস্ত আশংকাকে অমূলক প্রমাণ করে আজ সে জেগে উঠেছে। চিকিৎসকেরা অনুমান করছেন তার শরীর হাইপোথারমিয়াতে আক্রান্ত হওয়ার কারণেই মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় রক্ত সঞ্চালিত না হওয়ার পরও তার মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
টিশা আমেদের জ্ঞান ফিরে আসার খবরে তার স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বিপুল আনন্দোচ্ছাস দেখা যায়।”
।তিষা তখন তার স্কুলের ছেলে মেয়েদের দেখল। সবাই দুই হাত তুলে আনন্দে চিৎকার করছে। তিশা জনকেও দেখতে পেল। সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে বলল “আমরা তোমাকে ভালোবাসি তিশা।”
খবর শেষ হবার পর তিশা আম্মুর হাত ধরে বলল, “টুইটি কেমন আছে আম্মু?”
আম্মু কোন উত্তর দিলেন না। তখন তিষার গলার স্বর কেঁপে গেল, “কেমন আছে টুইটি?”
আম্মা তিষার মাথায় হাত রেখে ফিসফিস করে বললেন, “নিশ্চয়ই খুব ভালো আছে মা। যেখানে গেলে সবাই খুব ভালো থাকে তোক বাঁচিয়ে দিয়ে টুইটি সেখানে চলে গেছে।”
তিষা দুই হাতে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে বসে রইল।
.
একজন মানুষ পুরো তিন মাস এক ভাবে বিছানায় শুয়ে থাকলে তার শরীরের অনেক কিছুই সাময়িকভাবে অচল হয়ে যায়, হঠাৎ করে সেটাকে সচল করা যায় না। তাই তিষাকে চট করে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হল না। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটু আধটু বই পড়তে দিলেও বেশীর ভাগ সময় তাকে টেলিভিশন দেখে সময় কাটাতে হল। টেলিভিশনে সে পৃথিবীর অনেক খবর জানতে পারলেও যে খবরটি তাকে সবচেয়ে চমকৃত করল সেটি হচ্ছে পোষা প্রাণী হিসেবে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে তৈরি করা নূতন একটা প্রাণী যার নাম এনিম্যান। সে যখন আচেতন হয়েছিল তখন এই ছোট প্রাণীটির আবিষ্কার নিয়ে প্রথম একটা সাংবাদিক সম্মেলন হয়। সারা পৃথিবীতেই এটা নিয়ে খুব হইচই শুরু হয়েছিল, মানুষের বাচ্চাকে কুকুর বেড়ালের মতো পোষা প্রাণী হিসেবে বিক্রি করা যাবে না এই রকম একটা দাবী নিয়ে পত্র পত্রিকায় লেখালেখি হল, টেলিভিশনে আলোচনা হল, ইনটারনেটে তুমুল বাকবিতণ্ডা হল। যে কোম্পানী এটা তৈরি করেছে তারা দাবী করল এটা মোটেও মানুষের বাচ্চা নয়, এটা জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে তৈরী করা একটা কৃত্রিম প্রাণী। এটি কেনো মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়নি, এটি তৈরী হয়েছে ল্যাবরেটরির বায়োসেলে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে তাতে সায় দিলেন। মনোবিজ্ঞানীরা প্রাণীটাকে নিয়ে গবেষণা করে বললেন এর বুদ্ধিমত্তা কুকুর বিড়াল জাতীয় স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সমান। তাই কেউ যদি কুকুর বিড়াল পোষা প্রাণী হিসেবে বেচাকেনা করতে পারে তাহলে এটা বেচাকেনা করতে দোষ কী?