উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জর মুখে হাসি ফুঠে উঠল, বলল, “অসাধারণ!”
“তুমি ঠিকই বলেছ বিল, এটি অসাধারণ। গবেষণার এই অংশটুকু ছিল সবচেয়ে কঠিন। কিন্তু আমরা সেটা করতে পেরেছি, আমরা সঠিকভাবে জিনেটিক কোডিং করতে পেরেছি। এটা করার জন্যে তার নার্ভাস সিস্টেমে কিছু পরিবর্তন আনতে হয়েছে, তার ব্যথার অনুভূতি তুলনামূলকভাবে কম।
“এর জন্মপদ্ধতি মোটামুটি জটিল, তবে যারা এটা কিনবে তাদের সেটা জানার প্রয়োজন নেই। আমরা একেবারে নবজাতক শিশু কখনোই ক্রেতাদের দেব না। এটাকে একটু বড় করিয়ে, একটু ট্রেনিং দিয়ে তারপর সাপ্লাই দেব। মানুষ যখন একটা কুকুর কিনে আনে তখন প্রথম প্রথম তাকে নানারকম ট্রেনিং দিতে হয়, এনিম্যানের বেলায় তার কোনো প্রয়োজন হবে না।
“এনিম্যানের আয়ু সর্বোচ্চ দশ বছর। তবে এর চেহারায় কখনো বার্ধক্যের ছাপ পড়বে না। এটি অসুস্থ হয়ে ধুকে ধুকে মারা যাবে না। মৃত্যুটি সবসময়েই হবে স্বাভাবিক। এর আকার হবে ছোট কুকুরের মতো, মানুষ ইচ্ছে করলেই তাকে কোলে নিতে পারবে। আদর করতে পারবে। এর কোনো জেন্ডার নেই এটি ছেলেও না মেয়েও না। যেহেতু আমরা এই প্রজাতিকে জন্ম দিতে যাব না তাই এর ছেলে মেয়ে নেই। এটি একই ধরণের, নিউট্রাল।”
লিডিয়া তখন ত্রিমাত্রিক প্রেজেন্টেশান শুরু করে বলল, “তুমি ইচ্ছে করলে এই প্রাণীটিকে আরো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে পারবে।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী বলল, “তার প্রয়োজন হবে না। তোমাকে অভিনন্দন লিডিয়া একটি অসাধারণ আবিষ্কারের জন্যে।”
“তোমাকেও ধন্যবাদ, আমাকে অসাধারণ সহযোগিতা করার জন্য।”
“এখন তোমার পরিকল্পনা কী?”
“আমার সকল দায়িত্ব শেষ। এখন পুরো দায়িত্ব মার্কেটিংয়ের। তুমি কংগ্রেস থেকে এটাকে পাশ করিয়ে দাও, আমরা প্রোডাকশান শুরু করে দেব।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জীর মুখে ধীরে ধীরে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে, “তুমি ধরে নাও এটা কংগ্রেস থেকে পাশ হয়ে গেছে। একটা সাংবাদিক সম্মেলন করে পৃথিবীর মানুষকে এনিম্যান সম্পর্কে জানানোর জন্য প্রস্তুত হও!”
লিডিয়া বলল, “আমি প্রস্তুত।”
০৬. তিষার আম্মু কেবিন থেকে বের হয়ে
তিষার আম্মু কেবিন থেকে বের হয়ে ক্লান্ত পায়ে হাসপাতালের করিডোর ধরে হেঁটে হেঁটে ওয়াটিং রুমের দিকে যেতে থাকেন। একটু পর বাইরে আলো হয়ে সূর্য উঠবে, কিন্তু তার ভেতরটুকু আর কখনোই আলোতে ঝলমল করে উঠবে না। প্রতি রাত তিনি তিষার পাশে বসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। গভীর কোমায় ঘুমন্ত তিষা কখন চোখ খুলে তার দিকে তাকাবে তিনি সেই আশায় গত তিন মাস বসে আছেন কিন্তু তিষা চোখ খুলে তাকায়নি। সম্ভবত কখনোই চোখ খুলে তাকাবে না, এইভাবে একটা বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিঃশব্দে একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে।
ওয়েটিং রুমের দরজা খুলে তিষার আম্মু ভেতরে ঢুকলেন। বড় একটা সোফায় একজন মহিলা কাত হয়ে বসে আছে। তার ছেলেটি গতকাল গাড়ী। একসিডেন্টে আহত হয়ে এখানে এসেছে। একটা ছোট শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে আরেকজন কমবয়সী মা পিঠ সোজা করে বসে আছে। তার স্বামী সম্ভবত আজ মারা যাবে।
আম্মু ঘরের এক কোনায় সোফায় বসলেন। দুই হাতের উপর মাথাটা রেখে চোখ বন্ধ করলেন। কতো অল্প ঘুম, কতো অল্প খাওয়া দিয়ে একজন মানুষ কতো দীর্ঘকাল বেঁচে থাকতে পারে সেটা তিনি গত তিনমাস ধীরে ধীরে আবিষ্কার করেছেন।
.
আই সি ইউয়ের এগারো নম্বর কেবিনে খুব ধীরে ধীরে তিষা চোখ খুলে তাকাল, “আমি এখন কোথায়?” এই ধরনের একটা ভাবনা তার মাথায় একবার উঁকি দিয়ে যায়। “আমার ঘরে আমার পায়ের দিকে বইয়ের শেলফ, এখানে শেলফ নেই, তাহলে কী আমি অন্য কোথাও?” তিষা আবার চোখ বন্ধ করল, “রাত্রি বেলা আমি লাইট নিভিয়ে ঘুমাই। এখানে আলো জ্বলছে। মাথার কাছে একটা টেলিভিশন! আমার ঘরে টেলিভিশন কেন? আমি এখন কোথায়?” তিষা আবার চোখ খুলে তাকাল, সে একটু নড়ার চেষ্টা করতেই শরীরে এক ধরনের আড়ষ্ট অনুভূতি কাজ করে, কোথায় জানি টান পড়ে আর সাথে সাথে দূরে কোথায় জানি এক ধরণের এলার্ম বেজে ওঠে। তিষা একটু অবাক হল, “এলার্ম কেন বাজে?”
প্রায় সাথে সাথে একজন মহিলা ঘরে এসে ঢুকল, মহিলাটির মাথায় নার্সদের মত ক্যাপ, তিষার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে মহিলটি বলল, “হানি, তুমি কী জেগেছ?”
তিষা মহিলাটির মুখের দিকে তাকায়, তাদের স্কুলের নার্স মিসেস স্মিথের মতো চেহারা কিন্তু সে মিসেস স্মিথ নয়। তিষা জিজ্ঞেস করল, “আমি কোথায়?”
“তুমি খুব ভালো জায়গায় আছ, হানি।”
“আমার কী কিছু হয়েছে?”
“তোমার অনেক কিছু হয়েছিল।”
“এখন?”
“হানি, এখন তুমি আমাদের সবার সব দুশ্চিন্তা দূর করে দিয়েছ।”
তিষা অবাক হয়ে লক্ষ্য করে একটি দুটি কথা বলতেই তার উপর বিচিত্র এক ধরনের ক্লান্তি এসে ভর করছে। সে এতো দুর্বল কেন? সে ফিসফিস করে বলল, “আমার আব্বু আর আম্মু কই?”
“তুমি এক সেকেন্ড অপেক্ষা কর আমি তোমার আম্মুকে ডেকে আনি। তুমি আবার ঘুমিয়ে যেয়ো না যেন!”
তিষা বলল, “না। আমি ঘুমাব না।”
ওয়েটিং রুমের দরজা খুলে নার্স ভিতরে উঁকি দেয়। কোনার একটা সোফায় দুই হাতের ওপর মাথা রেখে তিষার আম্মু চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। ঘুমিয়ে আছেন না জেগে আছেন বোঝা যায় না। নার্স কাছে গিয়ে নিচু গলায় ডাকল, “মিসেস আহমেদ।”