প্রায় দুই ঘণ্টা ড্রাইভ করে তারা সেই জমে যাওয়া হদে উপস্থিত হলো। এমনিতে দেখে বোঝার উপায় নেই কোথায় শক্ত মাটি কোথায় হ্রদ সবকিছু ধবধবে সাদা বরফে ঢাকা। একটু লক্ষ করলে বোঝা যায়, যেখানে হ্রদ ছিল সেখানে গাছ নেই, আশে পাশে পাতা ঝড়ে যাওয়া অনেক গাছ।
উইক এন্ড বলে আজকে অবশ্যি অনেক মানুষ। দূরে গাড়ী পার্ক করে সবাই হ্রদের উপর স্কেটিং করতে চলে এসেছে। উজ্জল রঙ্গীন কাপড় পরে নানা বয়সী মানুষ ছোটাচ্চুটি করছে, দেখতে ভারি ভালো লাগে। তিষা গাড়ী থেকে নেমে তার স্কেটগুলো হাতে নিয়ে সামনে ছুটে যেতে থাকে, তার ভাব দেখে মনে হয় সামনে যে বিশাল আনন্দোৎসব চলছে একটু দেরী করলেই সেটা বুঝি শেষ হয়ে যাবে। টুইটিরও উৎসাহের শেষ নেই, সে তিষার পিছনে পিছনে ডাকতে ডাকতে ছুটতে থাকে।
আব্বু আর আম্মু গাড়ী থেকে বের হয়ে আসেন। দুই হাত ঘষে একটু উষ্ণতা তৈরী করতে করতে তারা বরফে ঢেকে যাওয়া হ্রদের একটু কাছে এগিয়ে যান।
তিষা কতোক্ষণ স্কেটিং করছিল মনে নেই, এই শীতের মাঝেও তার শরীর প্রায় ঘেমে গিয়েছে। তাদের ক্লাসের কয়েকজন এতো চমৎকার আইস স্কেটিং করতে পারে যে দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। বরফের ওপর এতো সুন্দর করে ঘুরপাক খায় যে দেখে মনে হয় কাজটা বুঝি খুবই সহজ। তিষা চেষ্টা করে দেখেছে, কাজটা মোটেও সহজ নয়, চেষ্টা করতে গিয়ে একটু পরপর বরফের ওপর আছাড় খেয়ে পড়েছে!
তিষা ঘুরপাক খেতে খেতে হ্রদের একপাশে চলে এসেছিল ঠিক তখন সে প্রথমে একজনের তারপর হঠাৎ করে সম্মিলিত মানুষের একটা ভয় পাওয়া আতংকের চিৎকার শুনতে পায়। তিষা দাঁড়িয়ে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কী হয়েছে, তখন সে মানুষের চিৎকারের পাশাপাশি বরফ ভাঙ্গার একটা চাপা আওয়াজ শুনতে পেল এবং পরমুহূর্তে তার পায়ের নিচ থেকে কিছু একটা সরে যাওয়ার অনুভূতি হল। কী ঘটছে সেটা বুঝতে কয়েক মুহূর্ত সময় নেয়। হ্রদের উপর যে বিশাল বরফের স্তর রয়েছে সেটা হঠাৎ করে ভেঙ্গে যেতে শুরু করেছে–এটা সত্যিই ঘটা সম্ভব কী না সেটা নিয়ে এই মুহূর্তে ভাবার সময় নেই, এখন এখান থেকে দ্রুত সরে যেতে হবে। তিষা দেখল আতংকে চিৎকার করতে করতে সবাই হ্রদের তীরে ছুটে যেতে শুরু করেছে। তিষা মাথা ঘুরিয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখল কোন দিকে গেলে সে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি তীরে পৌঁছাতে পারবে, তারপর ঘুরে সে সেদিকে ছুটতে থাকে ঠিক তখন তার সামনে হঠাৎ করে বরফের এটা ফাটল বের হয়ে নিচ থেকে কুচকুচে কালো হিমশীতল পানি বের হয়ে আসে। তিষা প্রাণপণে নিজেকে থামানোর চেষ্টা করে কিন্তু সে থামতে পারল না। তিষা বরফের উপর শুয়ে পড়ে বরফকে খামচে ধরে নিজেকে থামাতে চেষ্টা করল কিন্তু তবু নিজেকে থামাতে পারল না। তিষা বরফের ফাটল দিয়ে হিমশীতল পানিতে পড়ে মুহূর্তের মাঝে তলিয়ে গেল। টুইটি ঠিক তখন ছুটতে ছুটতে সেখানে এসেছে, বরফের ফাটলের সামনে দাঁড়িয়ে সেটি একবার হাহাকার করে ডাকল, তারপর কেউ কিছু বোঝার আগে কালো হিমশীতল পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
তিষার আলু আর আম্মু এক ধরনের আতংক নিয়ে হ্রদের দিকে তাকিয়েছিলেন, কী ঘটছে বুঝতে তাদের একটু সময় লাগল। এতো মানুষের ভীড়ে তিষাকে খুঁজেও পাচ্ছিলেন না, যখন সব মানুষ নিরাপদে সরে এসেছে। এবং তাদের ভেতরে কোথাও তিষা কিংবা টুইটিকে খুঁজে পেলেন না। তখন হঠাৎ করে একটা অচিন্ত্যনীয় ভয়াবহ আতংকে তারা পাথর হয়ে গেলেন। যারা ছুটে এসেছে তাদের মুখে আব্বু আম্মু শুনতে পেলেন বরফের ফাটল দিয়ে লাল পার্কা পরা একটি মেয়ে পড়ে গেছে আর তার পিছু পিছু একটা কুকুর সেখানে ঝাঁপ দিয়েছে, তখন হঠাৎ করে তিষার আব্বু আম্মুর পুরো জগৎটি মুহূর্তে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল। আম্মু চিৎকার করে সেখানে ছুটে যেতে চাচ্ছিলেন কিন্তু তাকে কেউ যেতে দিল না, সবাই মিলে তাকে ধরে রাখল।
বেশ কয়েকজন সতর্ক ভাবে তিষার খোঁজে এগিয়ে গেল, বরফের ফাটল দিয়ে উঁকি দেয়া কুচকুচে কালো পানিতে তিষার কোনো চিহ্ন নেই। তিষা সাঁতার জানে কিন্তু এই হিমশীতল পানিতে ডুবে বরফের নিচে চলে গেলে সেখান থেকে বের হওয়া অসম্ভব ব্যাপার। নিঃশ্বাস নিতে না পারলে মানুষ কয়েক মিনিটের বেশি বেঁচে থাকতে পারে না। এর মাঝে বেশ কয়েক মিনিট সময় পার হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে সময় পার হয়ে যাচ্ছে এই বরফের নিচ থেকে তিষাকে জীবিত উদ্ধার করার সব আশা খুব দ্রুত শেষ। হয়ে যেতে শুরু করল।
উদ্ধারকারীদের খবর দেওয়া হয়েছে, তারা কিছুক্ষণের মাঝে চলে আসবে, কিন্তু যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান তখন এই উদ্ধারকারী দলের এখানে পৌঁছে কিছু করার থাকবে না। তারা এসে হয়তো তিষার মৃতদেহটা শুধু উদ্ধার করবে।
ঠিক এরকম সময়ে মানুষজনের চিৎকার শোনা গেল, বরফের ফাটলের এক জায়গায় লাল পার্কার একটা অংশ দেখা যাচ্ছে তার পাশে কিছু একটা নড়ছে, নিশ্চয়ই টুইটি। বেশ কয়েকজন মানুষ ছুটে যায়, তারা তিষার হিমশীতল শরীরটি টেনে তোলে। ক্লান্ত শ্রান্ত টুইটি বরফের ফাটলে পা রেখে ওঠার চেষ্টা করে, উঠতে পারে না। একজন তাকে ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করে কিন্তু তার হাত পিছলে টুইটি আবার পানিতে পড়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্যে টুইটিকে দেখা যায় না, একটু পর সে আবার ভেসে উঠে, আবার সে ওঠার চেষ্টা করে। উঠতে পারে না, একজন তাকে ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করল, পারল না, টুইটি আবার তলিয়ে গেল, আর তাকে দেখা গেল না।