- বইয়ের নামঃ এনিম্যান
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. লিডিয়া কাফেটেরিয়ার এক কোনায়
এনিম্যান – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
উৎসর্গ
গণজাগরণ মঞ্চের তরুণ তরুণীদের। যারা মুক্তিযুদ্ধের জয় বাংলা শ্লোগানটি আবার নূতন করে আমাদের উপহার দিয়েছে।
০১.
লিডিয়া কাফেটেরিয়ার এক কোনায় বসে তার কফির কাপে চুমুক দিয়ে চারপাশের মানুষগুলোকে লক্ষ্য করে। বাইশ বছরের একটা মেয়েকে সুন্দরী বলার জন্যে তার ভেতরে যে যে বৈশিষ্ট্যগুলো থাকতে হয় লিডিয়ার মাঝে তার সবগুলোই আছে কিন্তু তবুও কেউ কখনো তাকে সুন্দরী হিসেবে বিবেচনা করেনি। অন্য কেউ সেই কারণটা না জানলেও লিডিয়া জানে। কারণটা একটু বিচিত্র, একজন মানুষের ভেতরটুকু সুন্দর না হলে তার বাইরের সৌন্দর্যটুকু ঠিক করে প্রকাশ পায় না। লিডিয়ার ভেতরটুকু অসুন্দর, এবং কদর্য। সে অসম্ভব বুদ্ধিমতী একটি মেয়ে কিন্তু তার ভেতরে বিবেক বলে কিছু নেই। মনোবিজ্ঞানীরা লিডিয়াকে নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ পেলে তাকে নিশ্চিতভাবেই সাইকোপ্যাথ বলে চিহ্নিত করতো। লিডিয়া কখনো কোনো মনোবিজ্ঞানীর কাছে যায়নি, যাবার প্রয়োজন হয়নি। সে খুবই সাধারণ একটা পরিবারে জন্ম নিয়ে স্বাভাবিক একটা পরিবেশে বড় হয়েছে। খুব অল্প বয়সেই তার মা প্রথমে লিডিয়ার ভেতরকার অস্বাভাবিকতাটুকু ধরতে পেরেছিলেন। তিনি কাউকে সেটি বলেন নি। একটু বড় হয়েই লিডিয়া তার পরিবারকে পরিত্যাগ করে নিজে একা একা বড় হয়েছে। একজন মানুষের মাঝে যখন কোনো ভালোবাসা, মায়া মমতা নীতি কিংবা বিবেক থাকে না তখন তার বেঁচে থাকা খুব সোজা। লিডিয়া তার অস্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তা নিয়ে খুব সফলভাবে বড় হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নিয়ে তার ভেতরে কোনো ভাবালুতা নেই। এই মূহুর্তে সে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ার এক কোনার একটি টেবিলে বসে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে চারপাশের ছাত্র-ছাত্রীদের এক ধরনের কৌতুকের দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে। ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্ছাস আগ্রহ, উৎসাহকে তার কাছে শিশুসুলভ ছেলেমানুষী মনে হয়।
লিডিয়া তার কফির কাপে চুমুক দিয়ে সামনে তাকাতেই একজন মধ্যবয়স্ক মানুষকে খাবারের ট্রে নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখল। কেউ বলে দেয়নি কিন্তু সাথে সাথে লিডিয়া বুঝে যায় মানুষটি তার কাছে আসছে। লিডিয়া ইচ্ছে করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় এবং সরাসরি না তাকিয়েই বুঝতে পারে মানুষটি এগিয়ে এসে তার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়েছে। পর মুহূর্তে সে মানুষটির গলা শুনতে পেল, “আমি কী তোমার টেবিলে বসতে পারি?”
লিডিয়া এবারে ঘুরে মানুষটির দিকে তাকাল, বড় কোম্পানীর ম্যানেজারের মতো চেহারা, দামী স্যুট, সুন্দর টাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ক্যাফেটেরিয়াতে এরকম পোষাক পরা মানুষেরা খেতে আসে না। লিডিয়া মানুষটির দিকে তাকাল, বলল, “অনেক খালি টেবিল আছে। তোমার এখানেই বসার কোনো প্রয়োজন নেই। তারপরও যখন এই টেবিলে বসতে চাইছ তার মানে তুমি নিশ্চয়ই আমার কাছে এসেছ?”
“লিডিয়া?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে আমি তোমার কাছেই এসেছি। ছবি দেখে মানুষের চেহারা বোঝা যায় না। তোমার ছবিতে তুমি অন্য রকম।”
এই কথাটি লিডিয়া অনেকবার শুনেছে। কথাটির প্রকৃত অর্থটিও সে জানে, প্রকৃত অর্থ হচ্ছে ছবিতে তোমাকে সুন্দরী একটি মেয়ে বলে মনে হয়। বাস্তবে তুমি মোটেও সুন্দরী নও।
মানুষটি টেবিলে খাবারের ট্রে টা রেখে লিডিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “আমার নাম রিকার্ডো।”
লিডিয়া খানিকটা অনিচ্ছা নিয়ে রিকার্ডো নামের মানুষটির হাত স্পর্শ করল, সে যে রকম অনুমান করেছিল ঠিক সেরকম তার হাত ভেজা এবং নরম। ভেজা হাতের মানুষের করমর্দন করতে লিডিয়ার এক ধরণের ঘৃণা হয়।
“তুমি আমার কাছে কেন এসেছ?”
মানুষটি তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাকে পাল্টা প্রশ্ন করল, “থিসিস জমা দিয়েছ?”
লিডিয়া মাথা নাড়ল। রিকার্ডো তার পেটের রোস্ট বীফের টুকরোটির ওপর মরিচের গুড়ো ছিটাতে ছিটাতে বলল, “থিসিসটি তুমি নিজে লিখলে কেন? তুমি নিজে লিখলে আরো অনেক ভালো থিসিস লিখতে পারতে।”
লিডিয়া ভয়ংকরভাবে চমকে উঠলেও বাইরে সেটা প্রকাশ করল না। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো তার মাথায় অনেকগুলো চিন্তা খেলে গেলো। একটি মেধাবী ছেলের সাথে অন্তরঙ্গতায় ভান করে সে তাকে দিয়ে থিসিস লিখিয়ে নিয়েছে। এ কথাটি সত্যি সে নিজে আরো ভালো লিখতে পারত কিন্তু এই ধরণের আনুষ্ঠানিক কাজে সে কোনো আগ্রহ পায় না। কাজ শেষ হবার পর মেধাবী ছেলেটিকে সে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে পরিত্যাগ করেছে। তার প্রয়োজন ছিল, ছেলেটি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে হারিয়ে গেছে। কিন্তু এই বিষয়টি কেউ জানে না বলে লিডিয়ার ধারণা ছিল, দেখা যাচ্ছে ধারণাটি সত্যি নয়। এই মানুষটি সেই ছেলেটির কেউ নয়, লিডিয়া জানে ছেলেটির কেউ নেই। মানুষটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে আসে নি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষে এই বিষয়টি নিয়ে কিছু করার ক্ষমতাও নেই। মানুষটি পুলিশ বা ডিটেকটিভ এজেন্সী থেকে হতে পারে, সেটি ঘটবে যদি মানসিক ভারসাম্যহীন মেধাবী ছেলেটি নির্বুদ্ধিতা করে আত্মহত্যা করে থাকে এবং মৃত্যুর কারণ হিসেবে এই ঘটনাটির কথা লিখে গিয়ে থাকে। ছেলেটি ভীতু প্রকৃতির ছিল তার পক্ষে আত্মহত্যার মতো সাহসের কাজ করা সম্ভব বলে মনে হয়নি। যেটাই ঘটে থাকুক লিডিয়াকে সতর্ক থাকতে হবে। সে তার জীবনে এই প্রথম নিজের ভেতর এক ধরণের ভীতি অনুভব করল।