মাঝবয়সী মানুষটি জিজ্ঞেস করল, আপনি কতজন মেয়ের ওপর এক্সপেরিমেন্ট করেছেন?
তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ।
কতজন মারা গেছে।
অর্ধেকের বেশি।
কতজন মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে?
বাকি অর্ধেক।
মেয়েগুলোকে কোথা থেকে এনেছেন?
পথঘাট থেকে। গরিবের মেয়ে।
আপনার এই প্রজেক্টে কে টাকা দিয়েছে?
আমেরিকার একটা জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি।
প্রজেক্টের উদ্দেশ্য কী?
নূতন ধরনের মানুষের জন্ম দেয়া। মানুষের জিনে পশু পাখির জিন মিশিয়ে দিয়ে নূতন ধরনের মানুষ তৈরি করা।
মাঝবয়সী মানুষ নিঃশ্বাস আটকে রেখে জিজ্ঞেস করল, এখন পর্যন্ত তৈরি হয়েছে কোনো নতুন ধরনের মানুষ?
পুরোপুরি হয়নি। বেশির ভাগ মেয়েই বিকলাঙ্গ বাচ্চা জন্ম দিয়েছে। জন্ম দিতে গিয়ে বেশির ভাগ মারা গেছে।
কী রকম বিকলাঙ্গ?
ডক্টর কাদের কোনো কথা বলল না। মিলিটারি অফিসার ধমক দিয়ে বলল, কী রকম বিকলাঙ্গ?
নাক চোখ মুখ নেই। হাত-পায়ের জায়গায় শুড়। তিন-চারটা চোখ। দুইটা মাথা। শরীরে আঁশ, এই রকম—
ক্রুদ্ধ তরুণ অফিসারটি ডক্টর কাদেরের মাথাটি আবার সশব্দে টেবিলে এনে আঘাত করার চেষ্টা করছিল কিন্তু মধ্যবয়স্ক মানুষটি তাকে শেষ মুহূর্তে থামিয়ে দিল। তরুণ অফিসারটি দাঁত কিড়মিড় করে বলল, খুন করে ফেলব। আমি এই বাস্টার্ডকে খুন করে ফেলব।
মধ্যবয়সী মানুষটি বলল, ঠিক আছে, আপনি খুন করবেন—কিন্তু আগে কয়েকটা কথা শুনে নিই। তারপর আবার ডক্টর কাদেরের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কেন এগুলো করেছেন?
শুধু আমি না, সারা পৃথিবীতে সব বৈজ্ঞানিকই এটা করে। এগুলো এক্সপেরিমেন্ট। এক্সপেরিমেন্ট করে করে বৈজ্ঞানিকরা নূতন নূতন জিনিস জানে। আমার এই ল্যাবরেটরি থেকে অনেক নূতন জিনিস আমি জেনেছি।
যে জিনিস জেনেছেন সেগুলো কোনো জার্নালে ছাপা হয়েছে?
ডক্টর কাদের কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, আমি জানি ছাপা হয় নাই। এগুলো জিনিস ছাপা হয় না। যে জ্ঞান দশজনের কাজে লাগে না সেটা বিজ্ঞান না। বিজ্ঞান মানুষকে নিয়ে এই রকম এক্সপেরিমেন্ট করে না। ডক্টর কাদের—আর যাই করেন আপনি মুখে বিজ্ঞানের কথা বলবেন না। বিজ্ঞানকে অপমান করবেন না।
ডক্টর কাদের কিছু একটা কলতে গিয়ে থেমে গেল, তার নাক দিয়ে রক্ত বের হয়ে সারা মুখ মাখামাখি হয়ে গেছে। টেবিলে তার মাথাটা ঠুকে দেয়ার পর মনে হয় একটা দাও নড়ে গেছে, মুখের ভেতর রক্ত, সব মিলিয়ে তাকে অত্যন্ত কদাকার দেখাচ্ছে। মধ্যবয়স্ক মানুষটি একটা নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল, এখন এই হাসপাতালে যে মেয়েগুলো আছে তাদের কী অবস্থা?
সবাই প্রেগনেন্ট। টেস্টটিউব বেবি।
সবার ফেটাসই জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং দিয়ে তৈরি?
হ্যাঁ।
কী রকম ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়েছে?
নানারকম। সরীসৃপের জিনস দেয়া আছে। বানর, কুকুর, ডলফিন। পাখি।
মধ্যবয়স্ক মানুষটা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তার মানে সবগুলো মেয়ের অ্যাবোরশন করাতে হবে?
ডক্টর কাদের নিচু গলায় বলল, সবাইকে পারা যাবে না। কেউ কেউ এত অ্যাডভান্সড স্টেজে যে এখন অ্যাবোরশন করানো সম্ভব না।
তাদের বাচ্চাগুলো হবে পশু আর মানুষের মিশ্রণ?
হ্যাঁ।
বাচ্চাগুলো বেঁচে থাকবে?
কেউ কম কেউ একটু বেশি।
তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়?
ডক্টর কাদের মাথা নাড়ল, বলল, নাহ্।
মেয়েগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়?
ডক্টর কাদের আবার মাথা নাড়ল, বলল, বিকলাঙ্গ আধা পশু আধা মানুষের বাচ্চা পেটে ধরে বেশির ভাগই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যায়। বেঁচে থাকাই তাদের জন্যে এক ধরনের কষ্ট। তাই বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করি না।
তরুণ মিলিটারি অফিসার আবার এগিয়ে এসে কেউ বাধা দেয়ার আগেই ডক্টর কাদেরের মাখার চুল ধরে তার মাথাটি সশব্দে টেবিলে এনে আঘাত করে। ডক্টর কাদের গোঙানোর মতো একটা শব্দ করল। যখন তার মাথাটি উঁচু করা হলো তখন দেখা গেল তার নাকটা হেঁতলে গেছে, সম্ভবত নাকের হাড়টা ভেঙে গেছে। ডক্টর কাদের থুথু ফেলার চেষ্টা করে এবং সেই থুথুর সাথে একটা ভাঙ্গা দাঁত বের হয়ে আসে। ভাঙা দাঁতটির দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ডক্টর কাদের বিড়বিড় করে বলল, আপনারা ঠিক বুঝতে পারছেন না। আমি একজন খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। আমার গায়ে হাত দেয়া যায় না। কেউ আমার গায়ে হাত দিতে পারে না।
কেউ কিছু বলার আগেই তরুণ অফিসারটি ডক্টর কাদেৱের চুলের ঝুঁটি ধরে টেনে তুলে তাকে একটা লাথি দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। এগিয়ে গিয়ে তাকে আরেকটা লাথি মারার আগে অন্যেরা তাকে থামিয়ে দিল। ডক্টর কাদেরের মুখ থেকে এক ঝলক রক্ত বের হয়ে আসে, সে ঠিক এই অবস্থায় ঘোলা চোখে হাসার চেষ্টা করে বলল, তুমি আমার কিছু করতে পারবে না। আমি হচ্ছি বিধাতার মতো। দ্বিতীয় বিধাতা। সারা পৃথিবীতে শুধু আমি নূতন। ধরনের মানুষের জন্ম দিয়েছি। শুধু আমি।
জহুর এগিয়ে গেল, ডক্টর কাদেরের মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ে বলল, তিনশ তেত্রিশ নম্বর কেবিনের মেয়েটির পেটেও কি এ রকম কোনো বাচ্চা আছে?
আছে।
কী রকম বাচ্চা?
পাখি আর মানুষের বাচ্চা।
পাখি আর মানুষ?
হ্যাঁ। পাখি আর মানুষ।
জহুর আরো একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটা কি বাঁচবে?
জানি না।
বাচ্চাটা?
ডক্টর কাদের তাঁর খ্যাতলানো মুখ, ভাঙা নাক এবং রক্তাক্ত মুখে হাসার চেষ্টা করে বলল, জানি না। যদি বাঁচে সে হবে প্রথম ইকারাস।