ডক্টর কাদের গোঙানোর মতো একটা শব্দ করল। জহুর ডক্টর কাদেরের কোমরে হাত দিয়ে উৎফুলু গলায় বলল, চমৎকার। বেল্ট পরে এসেছেন। আপনার হাত বাঁধার জন্যে কিছু একটা খুঁজছিলাম।
ডক্টর কাদের একটু ছটফট করার চেষ্টা করল, কিন্তু জহুর তাকে কোনো সুযোগ দিল না, শক্ত করে বালুর মাঝে চেপে রাখল। কোমর থেকে বেল্টটা খুলে সে তার হাত দুটো পেছনে নিয়ে বেঁধে ফেলে সন্তুষ্টির গলায় বলল, হাতগুলো ব্যবহার করতে না পারলে দৌড়াদৌড়ি করা যায় না। আমার ধারণা এখন আপনি আর পালানোর চেষ্টা করবেন না।
ডক্টর কাদের বালু থেকে মুখ সরিয়ে বলল, আপনি কে?
জহুর বলল, আপনি আজ দুপুরে আমার ইন্টারভিউ নিলেন—চাকরি দিতে চাইলেন—
আমি জানি। আসলে আপনি কে?
আমি আসলে কেউ না। খুবই সাধারণ একজন মানুষ!
ডক্টর কাদের মুখ থেকে বালু বের করার চেষ্টা করতে করতে বলল, আপনি যদি আমাকে ছেড়ে দেন, চলে যেতে দেন তাহলে যত টাকা চান তত টাকা দেব। আপনার সাথে আমি একটা ডিল করতে চাই
জহুর তার পকেট থেকে ময়লা একটা রুমাল বের করে ডক্টর কাদেরের চোখ দুটো বেঁধে ফেলে বলল, এখন চোখ দুটোও বেঁধে ফেলেছি—হঠাৎ করে দৌড় দেয়ার ইচ্ছা থাকলেও সেটা করতে পারবেন নী। রুমালটা একটু ময়লা সে জন্যে কিছু মনে করবেন না—
ডক্টর কাদের কাতর গলায় বলল, আমার কথা একটু মনোযোগ দিয়ে শুনেন। আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ, কেউ আমাকে শেষ পর্যন্ত কিছু করতে পারবে না—শুধু শুধু একটু ঝামেলা হবে। আপনি যদি আমাকে একটু সহযোগিতা করেন আপনারও লাভ, আমারও লাভ। আমি পেমেন্ট করব ডলারে। ক্যাশ! এক্ষুনি।
জহুর ডক্টর কাদেরকে টেনে নিজের পায়ের উপর দাঁড় করিয়ে বলল, আমি চাষাভূষো মানুষ। টাকা-পয়সা সে রকম নাই। কোনোদিন নিজের চোখে ডলারও দেখি নাই। সব সময় জানার ইচ্ছে ছিল একজন হারামির বাচ্চা আরেকজন হারামির বাচ্চাকে ঘুষ দেয়ার সময় কীভাবে সেটা দেয়। কীভাবে কথা বলে। আপনার কথা থেকে সেটা এখন বুঝতে পারলাম—কথাবার্তা হয় সোজাসুজি—
ডক্টর কাদের বলল, আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন না।
জহুর পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে বলল, সেটা সত্যি কথা। মনে হয় বুঝতে পারছি না। আপনি বোঝান–দেখি বুঝি কি না। তবে হাঁটতে হাঁটতে বোঝান। যারা আপনাকে ধরতে এসেছে আপনাকে তাদের হাতে না দেয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না। বলেন কী বলবেন—
ডক্টর কাদের কোনো কথা বলল না, হঠাৎ করে সে বুঝতে পেরেছে তার কথা বলার কিছু নেই। তার চোখ রুমাল দিয়ে বাঁধা তাই সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না—দেখতে পেলেও কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হতো না, তার ভবিষ্যটুকু এ রকম অন্ধকারই দেখা যেত।
ডক্টর কাদেরের অফিসে ডক্টর কাদেরের আরামদায়ক নরম চেয়ারেই ডক্টর কাদেরকে বসানো হয়েছে—শুধু একটা পার্থক্য, তার দুই হাতে এখন হ্যান্ডকাফ লাগানো। চোখ থেকে রুমালের বাঁধন খুলে দেয়া হয়েছে, তার ঝকমকে চোখগুলো এখন নিষ্প্রভ। চোখের নিচে কালি, মাথার চুল এলোমেলো, চেহারায় একটা মলিন বিধ্বস্ত ভাব।
তার সামনে একটা চেয়ারে একজন তরুণ মিলিটারি অফিসার বসে আছে। সে একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, আমি শুধু ডক্টর ম্যাঙ্গেলার নাম শুনেছিলাম, এখন নিজের চোখে ডক্টর কাদেরকে দেখতে পেলাম। কথা বলার সময় সে ডক্টর শব্দটাতে অনাবশ্যক এক ধরনের জোর দিল।
জহুর ঘরের এক কোনায় পঁড়িয়েছিল, ডক্টর কাদেরকে ধরে এনে দেয়ার জন্যে তাকে পুলিশ মিলিটারি অনেকটা নিজেদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করছে, ঘরের ভেতর থাকতে দিয়েছে। জহুরের খুব কৌতূহল হচ্ছিল ডক্টর ম্যাঙ্গেলা কে আর ডক্টর কাদেরের সাথে তার কী সম্পর্ক থাকতে পারে সেটা জানার জন্যে, কিন্তু জিজ্ঞেস করতে সংকোচ হচ্ছিল। জহুরের অবশ্যি জিজ্ঞেস করতে হলো না, তরুণ অফিসার নিজেই তার ব্যাখ্যা দিয়ে দিল, বলল, নাৎসি জার্মানিতে ডক্টর ম্যাঙ্গেলা জীবন্ত মানুষকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করত আর আপনি মানুষের জন্ম নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেন। এই হচ্ছে পার্থক্য।
ডক্টর কাদের কোনো কথা বলল না, পাথরের মতো মুখ করে বসে রইল। ডক্টর কাদেরের ডেস্কের সামনে একটা চেয়ারে বসে থাকা গুরুত্বপূর্ণ চেহারার সাধারণ পোশাকের মাঝবয়সী একজন মানুষ বলল, আপনি কতজন মেয়ের ওপর এই এক্সপেরিমেন্ট করেছেন?
ডক্টর কাদের এবারেও কোনো কথা বলল না। মাঝবয়সী মানুষটি আবার জিজ্ঞেস করল, কতজন মেয়ের ওপর এই এক্সপেরিমেন্ট করেছেন?
ডক্টর কাদের বিড়বিড় করে বলল, আমি আমার এটর্নির সাথে কথা বলে আপনাদের কথার কোনো উত্তর দেব না।
তরুণ অফিসারটি এবারে শান্ত ভঙ্গিতে চেয়ার থেকে উঠে ডক্টর কাদেরের কাছে এগিয়ে গেল, তারপর খপ করে তার চুলের কুঁটি ধরে টেনে এনে ফিসফিস করে বলল, তোমাকে আমি মানুষ হিসেবে বিবেচনা করি না কাদের ডাক্তার। তোমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে আমার এক মিনিটও লাগবে না। তোমাকে যে প্রশ্ন করা হচ্ছে তার উত্তর দাও, তা না হলে এই টেবিলে আমি তোমার নাক-মুখ থেঁতলে ফেলব।
মাঝবয়সী মানুষটি জিজ্ঞেস করল, ডক্টর কাদের, আপনি কতজন মেয়ের ওপর এক্সপেরিমেন্ট করেছেন?
ডক্টর কাদের উত্তর না দিয়ে আবার বিড়বিড় করে অস্পষ্ট স্বরে কিছু একটা বলল, শুধু এটর্নি শব্দটা একটু বোঝা গেল। কথা শেষ হওয়ার আগেই তরুণ মিলিটারি অফিসার ডক্টর কাদেরের চুলের খুঁটি ধরে সশব্দে তার মুখটাকে টেবিলে আঘাত করল। যখন চুলের ঝুঁটি ধরে তাকে তুলে আনল তখন দেখা গেল নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। মিলিটারি অফিসার আবার ফিসফিস করে বলল, কাদের ডাক্তার, তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না। তোমাকে বিচার করে ফাসিতে ঝুলিয়ে আমার কোনো আনন্দ নেই। কিন্তু এই টেবিলে তোমার মুখটাকে থেঁতলে দিয়ে মাথার ঘিলু বের করে দিলে আমার আনন্দ আছে! মানুষ মারতে হয় না—কি দানবকে মারতে কোনো সমস্যা নাই। কথার উত্তর দাও।