হ্যাঁ।
আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন?
জহুর শান্ত গলায় বলল, এই দ্বীপের মাঝে আপনি যে হাসপাতালটা বানিয়েছেন, এটা আসলে হাসপাতাল না। এটা অন্য কিছু। আমি জানতে চাইছি এটা কী?
ডক্টর কাদের কয়েক মুহূর্ত জহুরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, এটা হাসপাতাল।
জহুর খুব বেশি হাসে না, তার মুখের মাংসপেশি হাসতে অভ্যস্ত নয় তাই সে যখন হাসে তাকে কেমন যেন বিচিত্র দেখায়। জহুর তার সেই বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করে বলল, আমার কাছে কোনো যন্ত্র নাই, কিন্তু যখন কেউ মিথ্যা কথা বলে আমি সেটা বুঝতে পারি।
ডক্টর কাদের কোনো কথা বলল না, জহুর নিচু গলায় বলল, কোথাও কাজ করার আগে আমার জানা দরকার সেখানে কী হয়। আমি জানি এটা আসলে হাসপাতাল না। এটা অন্য কিছু। এখানে কাজ করার আগে আমাকে জানতে হবে এটা কী।
ডক্টর কাদের কিছুক্ষণ জহুরের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কেমন করে জানেন এটা অন্য কিছু?
আমি জানি। তা ছাড়া—
তা ছা কী?
তা ছাড়া তিনশ তেত্রিশ নম্বর কেবিনে যে মেয়েটি আছে—
ডক্টর কাদের হাত তুলে জহুরকে থামাল। ঠিক আছে। আপনি এখানে আরো একদিন থাকেন। কাল ভোরে আমি আপনার সাথে কথা বলব। আমি আপনাকে বলব এটা কী।
এই জায়গাটা কী জানার জন্যে জহুরকে অবশ্যি পরের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো না—সেদিন রাতেই সে সেটা জানতে পারল।
১.৩ গভীর রাতে জহুরের ঘুম ভাঙল
গভীর রাতে জহুরের ঘুম ভাঙল মেশিনগানের গুলির শব্দে। শুধু মেশিনগানের গুলির শব্দ নয়, তার সাথে অনেকগুলো হেলিকপ্টারের শব্দ। সে অনেক মানুষের গলার আওয়াজ এবং মানুষের ছোটাছুটির শব্দও শুনতে পেল। জহুর কখনো কোনো যুদ্ধ দেখেনি কিন্তু তার মনে হলো এই দ্বীপটা হঠাৎ একটা যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে গেছে এবং এটাকে সৈন্যরা আক্রমণ করেছে।
জহুর ডর্মিটরিতে যে ঘরটিতে ঘুমুচ্ছিল সেখানে তার বিছানা ছাড়াও আরো তিনটি বিছানা ছিল। সেই বিছানাগুলোতে তার মতোই আরো কয়েকজন মানুষ ঘুমিয়েছিল এবং হেলিকপ্টার আর মেশিনগানের শব্দ শুনে তারাও লাফিয়ে উঠে বসে এবং আতঙ্কে ছোটোছুটি শুরু করে দেয়। তাদের ছোটাছুটি দেখে জহুরের কেমন যেন হাসি পেয়ে যায়, সে নিচু গলায়। তাদেরকে বলল, আপনারা শুধু শুধু ছুটোছুটি করবেন না-মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকেন।
একজন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, যদি কিছু হয়?
হবে না। এখানে ডাকাত পড়েনি, পুলিশ মিলিটারি এসেছে।
মানুষগুলো মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, আপনি কেমন করে জানেন?
আমি জানি। এই দেশের কোনো ডাকাতের দলের হেলিকপ্টার নাই।
জহুর তার শার্ট প্যান্ট পরল, জুতো পরল। একজন সেটা দেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি কী করেন?।
বাইরে যাই। দেখে আসি কী হচ্ছে।
সর্বনাশ! যদি কিছু হয়?।
কিছু হবে না। আমি চোরও না, ডাকাতও না। আমার কিছু হবে কেন?
জহুর ভূমিটরির দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এলো। দ্বীপের মাঝামাঝি হাসপাতালের গেটের সামনে বেশ কিছু মানুষের ভিড়, অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না, তবে মনে হয় অস্ত্র হাতে অনেক পুলিশ আর মিলিটারি। তারা। কোনো খবর পেয়ে এখানে এসেছে। ঠিক কেন এসেছে, কাকে ধরতে এসেছে জহুর কিছুই জানে না কিন্তু সে অনুমান করতে পারল নিশ্চিতভাবেই তারা প্রথমেই ডক্টর কাদেরকে ধরবে। জহুর হঠাৎ করে বুঝতে পারল ডক্টর কাদের সম্ভবত তার গোপন সুরঙ্গ দিয়ে এখন হাসপাতালের ভেতর থেকে সরাসরি দ্বীপের কিনারায় এসে স্পিডবোটে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে।
জহুরের মনে হলো পুলিশ মিলিটারির দলটাকে সেটা জানানো উচিত। কিন্তু তার মতো চেহারার এত সাধারণ একজন মানুষের কথাকে পুলিশ মিলিটারি কোনোভাবেই গুরুত্ব দেবে না, উল্টো সে নিজে অন্য ঝামেলায় পড়ে যেতে পারে। তার থেকে বুদ্ধিমানের কাজ হবে সোজাসুজি সেই গোপন সুরঙ্গের আশেপাশে থেকে দ্রক্টর কাদেরকে ধরে ফেলা। জুহুর তাই আর দেরি করল না, আবছা অন্ধকারে খোয়া ঢাকা পথে পা চালিয়ে সমুদ্রের তীরের দিকে ছুটে চলল।
অন্ধকারে জায়গাটা চিনতে একটু সমস্যা হচ্ছিল কিন্তু মোটামুটি অনুমান করে জহুর শেষ পর্যন্ত ঠিক জায়গায় এসে উপস্থিত হলো। স্পিডবোটের কাছাকাছি একটা গাছের আড়ালে সে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে। হাতে কোনো ধরনের একটা অস্ত্র থাকলে ভালো হতো কিন্তু সে রকম কিছু না পেয়ে জহুর একটা শুকনো ভাল কুড়িয়ে নেয়। তার ধারণা সত্যি হলে কোনো একটা গোপন দরজা খুলে ডক্টর কাদের বের হয়ে এখন এদিকে এগিয়ে আসবে।
জহুর দ্বীপের মাঝখানে হাসপাতালের ভেতর অনেক মানুষের কথাবার্তা শুনতে পায়। পুলিশের হুঁইসেল বুটের শব্দ এবং হঠাৎ হঠাৎ গুলির আওয়াজ। গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে জহুর যখন আশা প্রায় ছেড়ে দিচ্ছিল তখন হঠাৎ করে বালুতে ঢেকে থাকা একটা দরজা সরিয়ে সেখান দিয়ে একটা ছায়ামূর্তি বের হয়ে আসে। অন্ধকারে ভালো দেখা না গেলেও মানুষটি যে ডক্টর কাদের সেটা বুঝতে জহুরের একটুও দেরি হলো না। সে গাছের নিচে ঘাপটি মেরে বসে থেকে বোঝার চেষ্টা করে কী ঘটছে।
ডক্টর কাদের কয়েকটা ব্যাগ আর কাগজপত্রের প্যাকেট নিয়ে মাথা নিচু করে স্পিডবোটের কাছে এগিয়ে আসে। সেগুলো স্পিডবোটে তুলে যখন সে দ্বিতীয়বার আরো কিছু জিনিস আনতে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন জহুর পেছন থেকে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। জহুরের ধাক্কায় ডক্টর কাদের মুখ থুবড়ে বালুর ওপর পড়ে যায়, জহুর এতটুকু দেরি না করে তার পিঠে চেপে বসে একটা হাত পেছনে টেনে আনে। ডক্টর কাদের যখন যন্ত্রণার একটা শব্দ করল তখন জহুর থেমে গিয়ে বলল, আমার ধারণা আপনি এখন আর নড়াচড়া করবেন না। করে লাভ নেই।