কাঁচাপাকা চুলের মানুষটি নিশ্চয়ই ডক্টর কাদের, সে এক সেকেন্ড দাঁড়ানোর কথা বললেও বেশ কিছুক্ষণ মাইক্রোস্কোপ থেকে চোখ তুলল না। জহুর অবাক হলো না। ক্ষমতাশালী মানুষেরা সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের ক্ষমতা বোঝানোর জন্যে এটা করে, তাদেরকে অকারণে দাঁড় করিয়ে রাখে। জহুর নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে যন্ত্রপাতিগুলো দেখতে থাকে। বেশির ভাগ যন্ত্রপাতিই সে চেনে না, শুধু ঘরের দেয়ালে লাগানো টেলিভিশন স্ক্রিনগুলো সে চিনতে পারল। এক একটা স্ক্রিনে দ্বীপের এক একটা সমুদ্রতীর দেখা যাচ্ছে। সে যখন দ্বীপটাকে ঘিরে ঘুরছিল তখন তাকে নিশ্চয়ই এই স্ক্রিনগুলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। ভালোই হয়েছে সুরঙ্গটা নিয়ে সে বেশি কৌতূহল দেখায়নি।
ডক্টর কাদের এক সময় মাইক্রোস্কোপ থেকে চোখ তুলে জহুরের দিকে তাকালো। কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে তাকিয়ে থেকে বলল, বসেন।
জহুর মাথা নাড়ল, বলল, বসতে হবে না।
জহুরের কথা শুনে ড. কাদেরের মুখে কোনো ভাবান্তর হলো না, সে শান্তু মুখে বলল, আমার এখানে ইন্টারভিউ দিতে হলে সামনে বসতে হবে। বসে হাত দুটো টেবিলে রাখতে হবে।
জহুরের ইচ্ছে হলো সে জিজ্ঞেস করে কেন তার চেয়ারে বসে টেবিলে হাত রাখতে হবে কিন্তু সে কিছু জিজ্ঞেস না করে চেয়ারে বসে টেবিলে হাত রাখল। জুর কাদের এসে টেবিলের অপর পাশে রাখা তার নরম আরামদায়ক চেয়ারটিতে বসে কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা দেখল। কি-বোর্ডে কিছু একটা লিখে ডক্টর কাদের জহুরের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি যতক্ষণ আপনার সাথে কথা বলব আপনি ততক্ষণ হাতটা টেবিলে চাপ দিয়ে রাখবেন।
কী কারণে হাত চাপ দিয়ে রাখতে হবে জহুরের সেটা জানার কৌতূহল হচ্ছিল কি সে সেটাও জানতে চাইল না, টেবিলে হাতটা একটু জোরে চেপে ধরল। ডক্টর কাদের বলল, চমৎকার। এবার আমি প্রশ্ন করব আপনি সেই প্রশ্নের উত্তর দেবেন।
জহুর বলল, ঠিক আছে।
ডক্টর কাদের মাথাটা একটু এগিয়ে এনে বলল, শুধু একটা ব্যাপার।
কী ব্যাপার?
আমি আপনাকে যে প্রশ্ন করব আপনি তার ভুল উত্তর দেবেন।
জহুর ভুরু কুঁচকে বলল, ভুল উত্তর?
হ্যাঁ। আপনি কোনো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবেন না।
সঠিক উত্তর দিতে পারব না?
না। প্রত্যেকটা উত্তর হতে হবে মিথ্যা—
মিথ্যা?
ড. কাদের মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। মিথ্যা।
কেন প্রশ্নের উত্তর মিথ্যা দিতে হবে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে জহুর থেমে গেল। তার কেন জানি মনে হলো এই প্রশ্নটার সঠিক উত্তরটা সে ডক্টর কাদেরের কাছ থেকে পাবে না।
ডক্টর কাদের জিজ্ঞেস করল, আমরা তাহলে শুরু করি?
করেন।
আপনার নাম কী?
জহুর বলল, আমার নাম ডক্টর কাদের।
জহুরের উত্তর শুনে ডক্টর কাদেরের মুখে হাসি ফুটে ওঠে, সে হাসিমুখে কম্পিউটারের দিকে তাকালো এবং হঠাৎ করে তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। সে ভুরু কুঁচকে জহুরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী বললেন আপনার নাম?
আমি বলেছি আমার নাম ডক্টর কাদের।
ডক্টর কাদের আবার কম্পিউটার মনিটরের দিকে তাকালো এবং তার মুখ কেমন জানি গম্ভীর হয়ে ওঠে। সে জিব দিয়ে নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি কখনো মানুষ খুন করেছেন?
করেছি।
ডক্টর কাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আবার জহুরের দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করল, কয়টা?
একটা।
কীভাবে?
একটা গামছা দিয়ে গলা পেঁচিয়ে ধরেছিলাম।
কেন খুন করেছেন?
পূর্ণিমার রাতে যখন অনেক বড় চাঁদ ওঠে তখন আমার মানুষ খুন করার ইচ্ছে করে।
ডক্টর কাদের কিছুক্ষণ তার কম্পিউটারের মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকে, জহুর বুঝতে পারে কোনো একটা বিষয় ডক্টর কাদেরকে খুব বিভ্রান্তু করে দিয়েছে কিন্তু সেটা কী জহুর ঠিক বুঝতে পারল না।
ডক্টর কাদের এবারে একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, আপনি কি আকাশে উড়তে পারেন?
জহুর মাথা নাড়ল, বলল, পারি।
কীভাবে ওড়েন?
পাখা দিয়ে।
আপনার কী পাখা আছে?
আছে। আমার দুটি বিশাল পাখা আছে। ভঁজ করে পিঠে লুকিয়ে রাখি—কেউ দেখতে পায় না।
আপনি কখন আকাশে ওড়েন?
সন্ধ্যেবেলা সূর্য ড়ুবে গেলে আমি আকাশে উড়ি। প্রতিদিন।
ডক্টর কাদের কিছুক্ষণ কম্পিউটার মনিটরের দিকে তাকিয়ে থেকে জহুরের দিকে তাকালো, বলল, আমার ইন্টারভিউ শেষ।
জহুর টেবিল থেকে হাত দুটো সরিয়ে নিয়ে বলল, আমি কি এখন যেতে পারি?
একটু দাঁড়ান।
জহুর চেয়ার থেকে উঠে একটু সরে দাঁড়াল। ডক্টর কাদের বলল, আমি আপনাকে আমার এখানে চাকরি দিতে চাই।
জহুর কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। ডক্টর কাদের বলল, আপনি কি এখানে চাকরি করবেন?
জহুর একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আপনি কেন আমাকে চাকরি দিতে চাইছেন?
কারণ আপনার নার্ভ ইস্পাতের মতো শক্ত।
আপনি কেমন করে জানেন?
আমি জানি। আপনি শান্ত গলায় শরীরের একটি লোমকূপেও একটু আলোড়ন না করে ভয়ঙ্কর বিচিত্র কথা বলে ফেলতে পারেন। আমি আগে এ রকম কখনো কাউকে দেখিনি।
তার মানে কী?
তার মানে আপনি কখনো উত্তেজিত হন না—আপনি অত্যন্ত ঠান্ডা মানুষ। ঠান্ডা মাথায় শান্তভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আমার আপনার মতো একজন মানুষের দরকার।
জহুর বলল, অ।
আপনি কি আমার এখানে চাকরি করবেন?
জহুর মাথা তুলে ডক্টর কাদেরের চোখের দিকে তাকালো, জিজ্ঞেস করল, তার আগে আমার জানা দরকার আপনি কী করেন?
ডক্টর কাদের থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করল, আমি কী করি?