জহুরের একবার ইচ্ছে করল নিচে নেমে গিয়ে গোপন পথের দরজাটি দেখে আসে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে চেষ্টা করল না। এটা আসলেই যদি গোপন সুরঙ্গ হয়ে থাকে তাহলে সে যদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এটা দেখার চেষ্টা করে তাহলে অনেকেই তার ওপর সন্দিহান হয়ে উঠবে। একদিনের জন্যে বেড়াতে এসে মানুষজনকে বিরক্ত করার তার কোনো ইচ্ছে নেই। হয়তো এই মুহূর্তেই তাকে কেউ কেউ তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করছে। কাজেই জহুর ভান করল সে কিছুই দেখেনি। অন্যমনস্কভাবে এদিক-সেদিক তাকিয়ে সে ইতস্তত ভাব করে আবার হেঁটে সামনে এগিয়ে যায়।
দ্বীপটা নিশ্চয়ই বেশ ছোট। কারণ বেশ অল্প সময়ের মাঝেই সে পুরোটা ঘুরে এলো। দ্বীপটা সাজানো-গোছানো এবং সুন্দর, মানুষজন বলতে গেলে নেই, পুরো দ্বীপটাই বেশ নির্জন। মূল দালানের বাইরে কয়েকটা ছোট ছোট দালান রয়েছে, এর মাঝে কোনো একটা সম্ভবত ডর্মিটরি। জহুর যদি সত্যি সত্যি এখানে চাকরি নেয় তাহলে তার এ রকম কোনো একটা ডর্মিটরিতে তার দিন কাটাতে হবে।
জহুর যখন হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে তার মার্বেল পাথরের মেঝে, হেলিকপ্টারের হেলিপ্যাড এসব দেখবে কি না চিন্তা করছিল তখন খাকি পোশাক পরা একজন মানুষ লম্বা পা ফেলে তার দিকে এগিয়ে এলো। মানুষটা কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করল, আপনি চাকরির জন্যে ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন?
জহুর মাথা নাড়ল। খাকি পোশাক পরা মানুষটা বলল, আপনার নাম জহুর হোসেন?
হ্যাঁ।
আমার সাথে আসেন— বলে মানুষটা ঘুরে জহুরের জন্যে অপেক্ষা করেই হাঁটতে শুরু করে।
জহুর কোনো কথা না বলে মানুষটার পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকে। খাকি পোশাক পরা মানুষটা হাসপাতালের দিকে এগিয়ে যায়, সামনে একটা বড় গেট, গেটটা বন্ধ। খাকি পোশাক পরা মানুষটা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তার গলায় ঝোলানো কার্ডটা গেটের নির্দিষ্ট একটা ফোকরে ঢুকিয়ে দিতেই গেটটা ঘরঘর শব্দ করে খুলে গেল।
খাকি পোশাকপরা মানুষটার সাথে ভেতরে ঢোকার সাথে সাথেই গেটটা আবার ঘরঘর শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। খাকি পোশাক পরা মানুষটা জহুরের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের তিনতলায় যেতে হবে।
তিনতলায়?
হ্যাঁ। স্যার তিনতলায় বসেন।
কোন স্যার? কীদের স্যার।
জহুল বলল, অ
খাকি পোশাক পরা মানুষটা ভেবেছিল কাদের স্যার কে সেটা নিয়ে জহুর কোনো একটা প্রশ্ন করবে, জহুর কোনো প্রশ্ন করল না তাই সে নিজে থেকেই বলল, কাদের স্যার আমাদের এম.ডি.।
জহুর বলল, অ।
কাদের স্যার নিজে সবার ইন্টারভিউ নেন।
জহুর আবার বলল, অ।
কাদের স্যারের মতোন দ্বিতীয় মানুষ কেউ কখনো দেখে নাই।
জহুর ভাবল একবার জিজ্ঞেস করে কেন কাদের স্যারের মতো দ্বিতীয় মানুষ কেউ কখনো দেখে নাই, কিন্তু কী ভেবে শেষ পর্যন্ত কিছু জিজ্ঞেস করল না, বলল, অ।
জহুরের জবাব দেবার ধরন দেখে খাকি পোশাক পরা মানুষটা এর মাঝে তার সাথে কথা বলার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে মুখ শক্ত করে এগিয়ে যায়, জহুরও কোনো কথা না বলে তার পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকে।
একটা লিফটে করে তিনতলায় উঠে যাওয়ার পর জহুর প্রথমবার হাসপাতালের ভেতরটা ভালো করে দেখার সুযোগ পেল। একটা বিশাল করিডোরের দুই পাশে ছোট ছোট অনেকগুলো কেবিন। হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ করে একটা কেবিনের জানালায় তার দৃষ্টি আটকে যায়, আঠারো উনিশ বছরের একটা মেয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, মেয়েটির মুখ পাথরের মতো ভাবলেশহীন, দেখে কেন জানি বুকের ভেতরটুকু কেঁপে ওঠে। জহুর সেখানে দাঁড়িয়ে গেল, মেয়েটি সরাসরি তার চোখের দিকে তাকিয়েছে। দেখে মনে হয় বুঝি কিছু একটা বলবে। জহুর জিজ্ঞেস করল, তুমি কি কিছু বলবে।
মেয়েটি মাথা নাড়ল। জহুর বলল, বল।
মেয়েটি কোনো কথা না বলে জহুরের দিকে তাকিয়ে রইল, কিছু বলল। খাকি পোশাক পরা মানুষটা তখন জহুরের পিঠে হাত দিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার ইঙ্গিত করে বলল, দাঁড়াবেন না। চলেন।
জহুর এই প্রথমবার নিজে থেকে কথা বলল। খাকি পোশাক পরা। মানুষটিকে জিজ্ঞেস করল, এই মেয়েটার কী হয়েছে?
মানুষটা কাঁধ বাঁকিয়ে বলল, মানসিক রোগ।
জহুর ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, মানসিক রোগ?
হ্যাঁ।
এইটা কি মানসিক রোগের হাসপাতাল?
এইটা সব রোগের হাসপাতাল।
সমুদ্রের মাঝখানে একটা দ্বীপের মাঝখানে কেমন করে সব রোগের হাসপাতাল তৈরি করে রাখা হয়েছে জহুরের সেটা জানার ইচ্ছে করছিল কিন্তু খাকি পোশাক পরা এই মানুষটাকে জিজ্ঞেস করে সেটা জানা যাবে বলে তার মনে হলো না, তাই সে কিছু জিজ্ঞেস করল না। হেঁটে ঘুরে যেতে যেতে সে আবার ঘুরে তাকালো, জানালার কাছে তখনো ভাবলেশহীন চোখে সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। হেঁটে যেতে যেতে কেবিনের নম্বরটি জহুরের চোখে পড়ল তিনশ তেত্রিশ। তিন তিন তিন।
খাকি পোশাক পরা মানুষটি করিডোরের শেষ মাথায় একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইন্টারকম সুইচে চাপ দিয়ে বলল, স্যার।
জহুর ইন্টারকমে একটা ভারী গলা শুনতে পেল, বল।
জহুর হোসেন ইন্টারভিউ দিতে এসেছে।
ভেতরে পাঠিয়ে দাও।
খাকি পোশাক পরা মানুষটি জহুরকে ভেতরে ঢোকার ইঙ্গিত করল। জহুর দর্জী খুলে ভেতরে ঢুকে একটু হকচকিয়ে যায়। সে মনে মনে খুব হাল ফ্যাশনের একটা অফিস দেখবে বলে ভেবেছিল, কিন্তু এটা মোটেও সে রকম নয়। ঘরের ভেতর চারপাশে অসংখ্য যন্ত্রপাতি, তার মাঝখানে কাঁচাপাকা চুলের একজন মানুষ একটা মাইক্রোস্কোপে চোখ লাগিয়ে কী। একটা দেখছিল, মাইক্রোস্কোপ থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, এক সেকেন্ড দাঁড়ান।