মিথিলা বিড়বিড় করে বলল, আমি পারব।
সে বাথরুমের তালাটা খুলে হাতে নিয়ে সেখানে তার ঘরের তালাটা ঝুলিয়ে দেয়। বাথরুমের ভেতর ঢুকে সে দরজা বন্ধ করে একটা বড় নিঃশ্বাস নেয়। এখন পর্যন্ত সবকিছু পরিকল্পনামতো হয়েছে। মিথিলার ইচ্ছে করল সে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দেয়। বাথরুমের ভেতর সে কয়েকবার বমি করার শব্দ করল, তারপর পানি ছিটিয়ে হাত-মুখ ধুতে শুরু করল। সে তার সুটকেসের চাবিটা নিয়ে এসেছে, সুতলি দিয়ে বাঁধা বাথরুমের চাবিটার জায়গায় স্যুটকেসের চাবিটা লাগিয়ে নেয়। বাথরুমের চাবিটা কোমরে খুঁজে নিয়ে সে বাথরুম থেকে বের হলো, বাইরে ডক্টর আসরাফ ঘুমঘুম চোখে দাঁড়িয়ে ছিল, মিথিলাকে জিজ্ঞেস করল, ঠিক আছে?
হ্যাঁ ঠিক আছে।
তাহলে ঘুমিয়ে যা।
ঘুম আসছে না। তোমার কাছে ঘুমের ট্যাবলেট আছে?
হ্যাঁ, আছে।
বেশি করে কয়েকটা দেবে? খেয়ে ঘুমাব।
বেশি করে নয়। একটা দিচ্ছি, খেয়ে ঘুমিয়ে যা।
মিথিলা তখন সুতলিতে বাঁধা স্যুটকেসের চাবিটা বাথরুমের চাবি হিসেবে আগের জায়গায় ঝুলিয়ে দেয়, তারপর নিজের ঘরে ঢোকে, ঢোকার সময় দরজার কড়ায় সে বাথরুমের তালাটা ঝুলিয়ে দিল। তারপর ঘরে ঢুকে নিজের বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।
ডক্টর আশরাফ একজন লোককে ডাকিয়ে মিথিলার ঘরটা একটু পরিষ্কার করিয়ে দেয়। তারপর মিথিলার হাতে একটা ট্যাবলেট দিয়ে বলল, এটা খেয়ে ঘুমিয়ে যা।
দুইটা দাও।
দুইটা লাগবে না। একটাই যথেষ্ট।
না আব্বু। আমাকে দুইটা দাও। আমি মড়ার মতো ঘুমাতে চাই।
একটু ইতস্তত করে ডক্টর আশরাফ তাকে দুইটা ট্যাবলেট দিল। মিথিলা দুইটা ট্যাবলেট নিয়ে মুখে দিয়ে ঢক ঢক করে পানি খেয়ে বলল, এখন আমি ঘুমাব।
ডক্টর আশরাফ বলল, হ্যাঁ, এখন ঘুমিয়ে যা।
গুড নাইট আব্বু। বলে সে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে জিভের নিচে লুকিয়ে রাখা ট্যাবলেট দুটো বের করে ফেলল, কী কুৎসিত গন্ধ, মনে হলো এবারে বুঝি সে সত্যি সত্যি বমি করে দেবে।
মিথিলা আরো ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করল তারপর সে উঠে বসল। কেউ এখন তাকে নিয়ে মাথা ঘামাবে না, সবাই জানে সে দুইটা ঘুমের ট্যাবলেই খেয়ে মরার মতো ঘুমাচ্ছে। মিথিলা সুটকেস থেকে তার একটা টি-শার্ট বের করে হাতে পেঁচিয়ে নিয়ে সাবধানে দরজার কাচে আঘাত করে। দরজার কাচকে সে যতটুকু শক্ত ভেবেছিল সেটা তার থেকে অনেক বেশি শক্ত। কোনো কিছু দিয়ে জোরে আঘাত করে ইচ্ছে করলেই সে কাচটা ভেঙে ফেলতে পারে কিন্তু সে কোনো শব্দ করতে চাচ্ছিল না।
শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টার পর কাচে একটা ফাটল তৈরি হলো, তখন সে সাবধানে চাপ দিয়ে একটা বড় টুকরো আলাদা করে নেয়। চাপ দিয়ে সাবধানে আরো একটু ভেঙে সে আরো কয়েক টুকরো কাচ সরিয়ে নেয়। এখন মোটামুটিভাবে হাত বের করার মতো জায়গা হয়েছে। চাবিটা নিয়ে সে হাতটা বাইরে বের করে দরজার কড়াতে লাগানো তালাটা খোলার চেষ্টা করে। দুই হাতে যে কাজটি পানির মতো সহজ, এক হাতে সেই কাজটিই প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। তার ভয় করছিল হঠাৎ করে তার হাত থেকে চাবিটা না নিচে পড়ে যায়, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
শেষ পর্যন্ত মিথিলা তালার ভেতর চাবি ঢোকাতে পারল এবং একটু চাপ দিতেই তালাটা খুট করে খুলে যায়। মিথিলা দরজার কড়া থেকে তালাটা খুলে নিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি সে শেষ পর্যন্ত মুক্ত হতে যাচ্ছে।
মিথিলা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর খুব সাবধানে দরজা খুলে কেবিন থেকে বের হয়ে আসে। বাইরে আবছা অন্ধকার, কেউ কোথাও নেই। লঞ্চের ইঞ্জিনের ধ্বক ধ্বক শব্দ ছাড়া আর কোথাও কোনো শব্দ নেই। মিথিলা রেলিংয়ের পাশে এসে দাঁড়ায়, পানি কেটে লঞ্চটা এগিয়ে যাচ্ছে। বাইরে আবছা অন্ধকার। মিথিলা আবার নিজের কেবিনে ঢুকে একটা পার্টির বোতল আর তার নিজের একটা তোয়ালে নিয়ে খুব সাবধানে বের হয়ে এল। এদিক সেদিক তাকিয়ে সে এবারে সাবধানে ছাদের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগল। তার ভয় হচ্ছিল ছাদে ওঠার দরজায় কেউ থাকবে, কিন্তু সেখানে কেউ নেই। তার আরো বেশি ভয় হচ্ছিল উপরে কেউ পাহারায় থাকবে কিন্তু ভাগ্য ভালো সেখানেও কেউ নেই।
ছাদের রেলিংয়ে বুলবুলকে বেঁধে রেখেছে। সে মাথা নিচু করে অবসন্নের মতো বসে ছিল, মিথিলা ছুটে গিয়ে তাকে স্পর্শ করতেই সে চোখ খুলে তাকালো, মিথিলাকে দেখে মুহূর্তের মাঝে তার মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে। সে নরম গলায় বলল, তুমি?
হ্যাঁ। আমি। আমাকে আটকে রেখেছিল, কোনোমতে পালিয়ে এসেছি।
আমি ভাবি নাই তোমার সাথে আর দেখা হবে।
আমিও ভাবি নাই। মিথিলা তার মাথায় গালে হাত বুলিয়ে বলল, কেমন আছ তুমি?
ভালো ছিলাম না। তুমি এসেছ এখন আমি খুব ভালো আছি।
মিথিলা বলল, কেউ এসে পড়বে। আগে তোমাকে খুলে দিই।
বুলবুল কোনো কথা বলল না। মিথিলা তার বাঁধন খুলে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল। খুব শক্ত করে বেঁধেছিল, মিথিলার খুব কষ্ট হলো বাঁধন খুলতে। শেষ পর্যন্ত যখন খুলতে পারল তখন বুলবুল তার দুই হাত আর পায়ে হাত বুলিয়ে হাসার চেষ্টা করল।
মিথিলা টাওয়েলটা ভিজিয়ে তার মুখ থেকে শুকনো রক্ত মুছিয়ে দিয়ে বলল, তুমি এখন যাও। কেউ এসে পড়ার আগে তুমি যাও। এক্ষুণি যাও।
বুলবুল অনেক কষ্ট করে হাসার চেষ্টা করল, বলল, আমার যাওয়ার ইচ্ছে করছে না।
মিথিলা তাকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল, লক্ষ্মী ছেলে আমার! ইচ্ছা না করলেও তোমাকে যেতে হবে।