তাহলে কি স্যার এটাকে মেরে ফেলব?
এই মুহূর্তে না। আমাদের ঢাকা ফিরতে ফিরতে এখনো তিন দিন। এর আগে আমরা কাউকে কিছু জানতে দিচ্ছি না। এই তিন দিন নিজেরা এটাকে স্টাডি করি। ঢাকায় ফেরার পর দেখা যাক। কাজেই তোমরা কেউ বিশ্রাম নেবে না, সবাই কাজ কর।
উৎসাহী বিজ্ঞানীরা মাথা নাড়ল, বলল, জি স্যার। আমরা বিশ্রাম। নিচ্ছি না।
ছবি ভিডিও তোলার আগে রক্ত মুছে নিও। ইনজুরিগুলো যেন দেখা যায়-প্রাণীটার মাঝে মানুষ মানুষ ভাব থাকায় মুশকিল। কেউ দেখলে অন্য রকম ভাবতে পারে!
জি স্যার। এখন মানুষের সমস্যা নিয়ে মানুষেরা যত ভাবে পশুপাখির সমস্যা নিয়ে তার থেকে বেশি ভাবে।
ঠিকই বলেছ।
ঠিক এ রকম সময় মিথিলাকে তার কেবিনে আটকে রাখা হয়েছিল। যে মানুষটি তার জন্যে খাবার এনেছে সে খানিকটা নির্বোধের মতো দাঁড়িয়ে আছে, কারণ মিথিলা পুরো ভাত তরকারি তার মুখের ওপর ছুড়ে মেরেছে। খবর পেয়ে ডক্টর আশরাফ এসেছে। তাকে দেখে মিথিলা অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে বলল, আব্বু।
বলো মিথিলা।
এটা কি সত্যি তুমি ওদের বলেছ আমাকে কেবিনের মাঝে তালা মেরে রাখতে?
ডক্টর আশরাফ বলল, এটাকে অন্যভাবে নিও না। তোমার ভালোর জন্য আমরা তোমাকে এখানে আটকে রাখছি।
আমার ভালোর জন্যে? মিথিলা চিৎকার করে বলল, আমার ভালোর জন্যে?
হ্যাঁ। তুমি অত্যন্ত নির্বোধের মতো কিছু কাজ করেছ।
কী কাজ করেছি?
পাখাওয়ালা ঐ প্রাণীটার সাথে ওড়ার চেষ্টা করেছ। তুমি কি জান তুমি কত বড় ঝুঁকি নিয়েছিলে?
কীসের ঝুঁকি?
প্রাণীটা যদি তোমাকে ওপর থেকে ফেলে দিত?
ফেলে দিত? আমাকে? কেন আমাকে ফেলে দিবে?
ডক্টর আশরাফ বলল, এ রকম ভয়ঙ্কর একটা বন্য প্রাণী যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। তুমি কেমন করে তার পিঠে উঠে আকাশে উড়তে গেলে? তোমার কি বিন্দুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান নাই?
আব্বু! ও মোটেও বন্য প্রাণী না—
আমার সাথে তর্ক করবে না। আমি এই বিষয়গুলো তোমার থেকে অনেক বেশি জানি। তুমি কি জানো সে কত হিংস্রভাবে আমার স্টুডেন্টদের আক্রমণ করেছে? আরেকটু হলে এটা তাদের মেরেই ফেলত।
আব্বু! তোমরা ওকে ধরার চেষ্টা করেছ আর সে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে না?
ডক্টর আশরাফ মাথা নেড়ে বলল, খুব একটা লাভ হয় নাই। তাকে আমরা ঠিকই ধরেছি।
শুধু ধরো নাই তাকে তোমরা মেরেছ। হঠাৎ করে মিথিলার গলা ভেঙে গেল, বলল, কেমন আছে এখন?
আছে একরকম।
বেঁচে আছে, নাকি তোমরা মেরে ফেলেছ?
মেরে ফেলব কেন?
লোহার রড দিয়ে তোমরা তার মাথায় মেরেছ—
আমাদের সেফটির জন্যে। একটা বন্য প্রাণী আমাদের আক্রমণ করবে আর আমরা চুপচাপ বসে থাকব?
মিথিলা একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, ঠিক আছে। এখন আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। আমাকে কেবিন থেকে বের হতে দিবে?
না।
ওকে একবার দেখতে দিবে?
কোনো প্রশ্নই আসে না।
আমাকে বাথরুমেও যেতে দিবে না?
সেটা দেব, তবে খুব সাবধানে। দেখতে হবে তুই যেন কোনো পাগলামি না করিস। একটু থেমে যোগ করল, আমরা ঢাকা রওনা দিয়ে দিয়েছি, দুই দিনে ঢাকা পৌঁছে যাব, তখন তোর যা ইচ্ছে হয় করিস।
ডক্টর আশরাফ চলে যাওয়ার পর মিথিলা কেবিনটা খুব ভালো করে পরীক্ষা করল। লোহার দেয়াল, লোহার দরজা ভেঙে বের হওয়ার কোনো প্রশ্ন নেই। দরজার মাঝে কাচ লাগানো আছে, সেই কাচ ভেঙে ফেলা যাবে কিন্তু বড় জোর সে তার হাতটা বের করতে পারবে। যদি কোনোভাবে তালার চাবিটা পেতে পারত তাহলে হাত বের করে তালাটা খুলতে পারত। কিন্তু চাবি পাবে কোথায়?
ঠিক তখন তার একটা জিনিস মনে পড়ল, বাথরুমেও তালা দেয়া আছে। ভাড়া করা লঞ্চ, কেবিনের প্যাসেঞ্জারের জন্যে আলাদা বাথরুমে রয়েছে। সাধারণ মানুষেরা যেন যেতে না পারে সে জন্যে তালা মারা থাকে, কেবিনের মানুষেরা যাওয়ার সময় চাবি নিয়ে স্কুলে বাথরুমে যায়। বাথরুমের চাবিটা প্রথমে নিজের কাছে রাখতে হবে, তারপর খুব সাবধানে তার কেবিনের তালাটাকে বাথরুমের তালা দিয়ে পাল্টে দিতে হবে। তারপর যখন কেউ লক্ষ করবে না তখন দরজার কাচ ভেঙে হাত বের করে চাবি দিয়ে তালাটা খুলে ফেলতে হবে, কাজটা সহজ নয় কিন্তু চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
কাজেই মিথিলা খুব ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করল। সে এর আগে কখনোই এ রকম কিছু করেনি, আজকে করবে। খুব ঠান্ডা মাথায় সে পুরোটা করবে, একটা শেষ চেষ্টা করবে।
রাতের খাবারটা সে আগের বারের মতো মানুষটার মুখে ছুড়ে দিল না। সে খানিকটা খেলো এবং খানিকটা লুকিয়ে রাখল। গভীর রাতে সবাই যখন মোটামুটি ঘুমিয়ে গেছে, তখন সে ঘরের ভেতর লুকিয়ে রাখা ভাততরকারি পানির সাথে মিশিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখে বমি করার মতো শব্দ করতে থাকে। সাথে সাথে দরজায় ধাক্কা দিয়ে শব্দ করতে থাকে।
কিছুক্ষণের মাঝেই খবর চলে গেল এবং ডক্টর আশরাফ উদ্বিগ্ন মুখে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল, জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মিথিলা?
শরীর খারাপ লাগছে আব্বু। বমি হচ্ছে।
বমি হচ্ছে? কেন?
জানি না। বলে আবার সে বমি করার ভঙ্গি করল, মনে হলো আবার বমি করে দেবে। ডক্টর আশরাফ তাকে ধরল, মিথিলা দরজার কপাট ধরে বমি করার ভঙ্গি করে দরজায় লাগানো তালাটা সাবধানে খুলে নেয়।
মিথিলা টলতে টলতে হেঁটে বাইরে ঝোলানো বাথরুমের চাবিটা নিয়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে যায়। ডক্টর আশরাফ বলল, আমি খুলে দিই।