অ।
কাদের স্যার চোখের দিকে তাকিয়ে ভেতরের সবকিছু বুঝে ফেলেন।
তাই নাকি?
জি। মানুষটা মাথা নাড়ল, চোখ দুইটা ধারালো ছোরার মতে। কেটে ভেতরে ঢুকে যায়।
জহুর কোনো কথা না বলে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে থাকে। সন্ধ্যের বাতাসে সমুদ্রের তীরের ঝাউগাছগুলো হাহাকারের মতো এক ধরনের শব্দ করছে, সেই শব্দ শুনলেই কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়।
দুই দিন পর জহুর আবিষ্কার করল সে জেটিতে এসে এম.ভি, শামস খুঁজে বের করে তার নীল রঙের ইন্টারভিউ কার্ড দেখিয়ে সেখানে চেপে বসেছে। কেন বসেছে নিজেও জানে না।
১.২ ট্রলারে বসে থাকা মানুষগুলো
ট্রলারে বসে থাকা মানুষগুলো কেউই খুব বেশি কথা বলে না—তাতে অবশ্যি জহুরের খুব সমস্যা হলো না, বরং একটু সুবিধেই হলো, কারণ সে নিজেও খুব বেশি কথা বলে না। ট্রলারের ইঞ্জিনের বিকট শব্দ—কথা বলতে হলেও সেটা বলতে হয় চেঁচিয়ে, কানের কাছে মুখ লাগিয়ে। যে হাসপাতালের মেঝে ইতালি থেকে মার্বেল এনে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে রোগী আনা হয় হেলিকপ্টারে সেই হাসপাতালে ইন্টারভিউ নেয়ার মানুষগুলোর জন্যে কেন আরেকটু ভালো ট্রলারের ব্যবস্থা করা যায় না, সেটা জহুর বুঝতে পারল না।
ট্রলারের ছাদে বসে জহুর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। জহুরের মনে হয় সমুদ্রের একটা নিজস্ব মেজাজ আছে আর সেই মেজাজের ওপর নির্ভর করে তার একটা নিজস্ব রূপ তৈরি হয়। যখন মেজাজ খারাপ থাকে তখন পানির রং হয় কালো, ঢেউগুলো ফুসে ওঠে। এই মুহূর্তে সমুদ্রের মনে হয়। ফুরফুরে হালকা মেজাজ তাই সমুদ্রের পানির মাঝে স্বচ্ছ হালকা একটা নীল রং, ছোট ছোট ঢেউ, তার ওপর সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করছে। জহুর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনেক দূরে হালকা ধূসর বর্ণের। একটা দ্বীপ দেখতে পেল। তারা এখন এই দ্বীপটাতেই যাচ্ছে।
খুব ধীরে ধীরে দ্বীপটা স্পষ্ট হতে থাকে, জহুরের ধারণা ছিল সে মাথা উঁচু করে থাকা বড় বড় দালান দেখতে পাবে কিন্তু সে রকম কিছু দেখল না। যতই কাছাকাছি আসতে থাকে দ্বীপটাকে ততই গাছগাছালি টাকা অত্যন্ত সাধারণ একটা দ্বীপ বলে মনে হতে থাকে। খুব কাছাকাছি আসার পর হঠাৎ একটা ছোট হেলিকপ্টারকে উঠে যেতে দেখা গেল—এটি না দেখলে এখানে যে কোনো বৈশিষ্ট্য আছে সেটা বোঝার কোনো উপায়ই থাকত না।
ট্রলারটা জেটিতে থেমে যাওয়ার পর জহুর অন্য মানুষগুলোর সাথে ট্রলার থেকে নেমে আসে। জেটিতে খাকি পোশাক পরা একজন মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল, সে সবাইকে কাছাকাছি একটা ছোট ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের সবাইকে একজন একজন করে একটা নীল পর্দার সামনে দাঁড়া করিয়ে একটা ছবি তুলে তাদের নাম পরিচয় লিখে আইডি কার্ড তৈরি করে দিল। একজন মহিলা জহুরের হাতে কার্ডটি তুলে দিয়ে বলল, যতক্ষণ এখানে থাকবেন এটা গলায় ঝুলিয়ে রাখবেন।
জহুর মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।
মনে রাখবেন এটা খুব জরুরি। এক সেকেন্ডের জন্যেও খুলবেন না। খুললে কিন্তু ঝামেলা হতে পারে।
ঝামেলা?
হ্যাঁ। এখানে সিকিউরিটি খুব টাইট।
একটা হাসপাতালে সিকিউরিটি কেন টাইট হতে হবে জুহুর সেটা খুব ভালো বুঝতে পারল না, কিন্তু সে এটা নিয়ে কোনো প্রশ্নও করল না। সে কম কথার মানুষ।
আপনি চলে যাওয়ার সময় আই.ডি, কার্ডটা এখানে জমা দিয়ে যাবেন?
জহুর মাথা নাড়ল, যাব।
এই দ্বীপে খাবার জায়গা আছে—আই ডি কার্ডটা দেখিয়ে যখন যা খেতে চান খেতে পারবেন।
ঠিক আছে।
পিছন দিকে একটা ডর্মিটরি আছে, যদি রাতে থাকতে হয় সেখানে থাকতে পারবেন।
ঠিক আছে।
আপনার যখন ইন্টারভিউ নেয়ার সময় হবে আপনাকে ডেকে আনা হবে।
জহুর ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কোথা থেকে ডেকে আনা হবে?
আপনি যেখানেই থাকেন সেখান ডেকে আনবে। সেটা নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।
সে যেখানেই থাকবে তাকে সেখান থেকেই কীভাবে ডেকে আনবে সেটা জহুর ঠিক বুঝতে পারল না, কিন্তু সে সেটা নিয়ে কোনো কথা বলল না, আইডি কার্ডটা গলায় ঝুলিয়ে বের হয়ে এলো।
দ্বীপের কিনারা দিয়ে একটা খোয়া বিছানো রাস্তা চলে গেছে—জহুর সেই রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করে। একটু পরপর বসার জন্যে পাথরের বেঞ্চ বসানো আছে, এই পাথরগুলো না জানি কোথা থেকে এনেছে। দ্বীপটা শুরুতে কেমন ছিল অনুমান করা কঠিন, এখন গাছগাছালিতে ঢাকা। খোয়া বিছানো রাস্তার দুই পাশে বড় বড় নারকেল গাছে, সমুদ্রের বাতাসে তার। পাতাগুলো শিরশির শব্দ করে কাঁপছে।
জহুর সরু রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পুরো এলাকাটা সম্পর্কে একটা ধারণা করার চেষ্টা করে। দ্বীপের মাঝামাঝি যে বড় দালানটি রয়েছে সেটা সম্ভবত মূল হাসপাতাল, দালানটা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে শুধু সামনের একটা বড় গেট দিয়ে সেখানে ঢোকা যায়। তাই এটাকে দেখে ঠিক হাসপাতাল মনে হয় না, মনে হয় একটা জেলখানা।
দ্বীপের খোয়া বাঁধানো রাস্তাটি ধরে হেঁটে হেঁটে জহুর দ্বীপের শেষ প্রান্তে চলে আসে। অনমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে জহুর লক্ষ করল, হঠাৎ করে খোয়া বাধানো রাস্তা শেষ হয়ে সেখানে খানিকটা পথ কংক্রিটের, সেটা শেষ হয়ে আবার খোয়া বাঁধানো পথ শুরু হয়েছে। জহুর দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করে-হঠাৎ করে খানিকটা জায়গা কংক্রিটের কেন? সে ডানে-বামে তাকালো, তার মনে হলো কংক্রিটে বাঁধানো অংশটুকু আসলে একটা সুরঙ্গের উপরের অংশটুকু। সুরঙ্গের অন্যপাশে মাটি ফেলে ঘাস লাগানো হয়েছে, এখানে লাগাতে পারেনি। দ্বীপের মাঝখানে যে হাসপাতালটি আছে সেখান থেকে সুরঙ্গটা এসেছে—সমুদ্রের তীরে গিয়ে শেষ হয়েছে। জহুর ভালো করে তাকিয়ে দেখে সুরঙ্গটা যেখানে শেষ হবার কথা সমুদ্রের তীরে সেখানে গাছগাছালি ঢাকা জায়গায় দুটো স্পিডবোট, ভালো করে না তাকালে সেটা দেখা যায় না। ব্যাপারটা হঠাৎ করে জহুরের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়—হাসপাতালের ভেতর থেকে হঠাৎ পালিয়ে যাওয়ার এটা একটা গোপন রাস্তা। জহুরের কাছে ব্যাপারটা খানিকটা দুর্বোধ্য ঠেকে—হাসপাতাল থেকে কেউ কেন কখনো গোপন পথে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে?