তখন মিথিলা তার মন খারাপের কথা বলল। তার মায়ের কথা বলল, তার মা কেমন করে মারা গেল সেই কথা বলল। তার স্কুলের কথা বলল, তার বন্ধুদের কথা বলল। বুলবুল তার জন্মের কথা বলল, জহুরের কথা বলল, আনোয়ারার কথা বলল। ডক্টর সেলিমের কথা বলল, লিপির কথা বলল। মিথিলা তার খেলার সাথীদের কথা বলল, তারপর গুনগুন করে একটা গান গেয়ে শোনাল।
ধীরে ধীরে যখন পুবের আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে তখন বুলবুল মিথিলাকে নিয়ে ফিরে আসে। তাকে লঞ্চের ছাদে নামিয়ে দিয়ে সে উড়ে যায়। তার সমস্ত শরীর ক্লান্ত কিন্তু বুকের ভেতর বিচিত্র এক ধরনের অনুভূতি—যার সাথে সে পরিচিত না। যেটা সে কোনোভাবে বুঝতে পারছিল না।
পরদিন ভোরে ডক্টর আশরাফ নাশতার টেবিলে তার মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে মেয়ের কেবিনে গিয়ে দেখতে পেল সে ঘুমে কাদা হয়ে আছে। ডক্টর আশরাফ ডেকে বলল, মিথিলা, মা উঠবি না? নাশতা করবি না?
মিথিলা ঘুমের মাঝে বিড়বিড় করে বলল, খুব ঘুম পাচ্ছে আব্বু! আমি এখন উঠব না!
ডক্টর আশরাফ মেয়েকে আর বিরক্ত করল না, সারারাত ঘুমানোর পরেও কেমন করে একজনের ঘুম পায় সেটা সে বুঝতে পারল না। এই বয়সী মেয়েদের তাদের বাবারা নিশ্চয়ই কখনো বুঝতে পারে না।
রাত্রিবেলা খাবার টেবিলে ডক্টর আশরাফ ঘোষণা করল তাদের এবারকার অভিযান শেষ, পরদিন ভোরে তারা ফিরে যাচ্ছে।
মিথিলা চমকে উঠে বলল, ফিরে যাচ্ছি?
হ্যাঁ।
কেন আব্বু? এত তাড়াতাড়ি কেন?
ডক্টর আশরাফ হেসে ফেলল, বলল, তাড়াতাড়ি? এই কয়দিন আগেই তুই একেবারে অধৈর্য হয়ে গিয়েছিলি কখন ফিরে যাব! এখন বলছিস তাড়াতাড়ি?
হ্যাঁ আব্বু। মিথিলা ইতস্তত করে বলল, আগে আমার ভালো লাগছিল না। এখন ভালো লাগছে।
ভালো লাগলে ভালো। আমরা আবার আসব।
কিন্তু—
কিন্তু কী?
আরো কয়েক দিন থাকো না আব্বু। অন্য কিছু স্টাডি করো।
অন্য কী স্টাডি করব?
বনে কত কী আছে। গাছপালা সাপ ব্যাঙ গোসাপ—
ডক্টর আশরাফ হেসে বলল, আমি তো গাছপালা সাপ ব্যাঙের এক্সপার্ট না। আমি পাখির এক্সপার্ট–
তাহলে পাখিই স্টাডি করো?
এ রকম সময় খাবার টেবিলের একপাশে বাস থাকা চশমা পরা। একজন বলল, স্যার, মিথিলার কথায় একটা যুক্তি আছে।
কী যুক্তি?
আজকে আমাদের লঞ্চের ছাদে এটা পেয়েছি। বলে চশমা পরা ছেলেটি ডক্টর আশরাফের দিকে একটা পালক এগিয়ে দেয়। পালকটি কমপক্ষে এক ফুট লম্বা এবং সেটি দেখে এক সাথে সবাই বিস্ময়ের একটা শব্দ করল। ডক্টর আশরাফ পালকটি হাতে নিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে সেটির দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর ধীরে ধীরে বলে, এর অর্থ তোমরা কি জান?
কী স্যার?
এর অর্থ এই পাখিটির ডানার বিস্তৃতি ছয় থেকে আট মিটার।
এটা কী পাখি স্যার?
আমি জানি না।
একজন অবাক হয়ে বলল, আপনি জানেন না?
না। আমার জানামতে এত বড় পাখি পৃথিবীতে নেই।
তাহলে এটা কোথা থেকে এল স্যার?
ডক্টর আশরাফ অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি জানি না।
আমরা কি এটা নিয়ে একটু স্টাডি করব? এটা খুঁজব?
আমরা গত কয়েক দিন যেভাবে স্টাডি করেছি তাতে এই পাখিটার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া উচিত ছিল। যেহেতু পাইনি—
ডক্টর আশরাফ আবার চুপ করে যায়, চশমা পরা ছেলেটি বলল, যেহেতু পাইনি?
যেহেতু পাইনি তার অর্থ, পাখিটা অনেক বুদ্ধিমান। নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে।
মিথিলা আস্তে আস্তে বলল, হয়তো এটা পাখি না।
এটা পাখি না? এটা তাহলে কী?
হয়তো এটা পরী।
সবার জোরে হেসে ওঠার কথা ছিল, কিন্তু কেউ হেসে উঠল না।
গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে গেছে তখন মিথিলা নিঃশব্দে লঞ্চের ছাদে উঠে এল। চাঁদের আলো খুব বিচ্ছিন্ন, জোছনা রাতে সেটি ঝলমল করতে থাকে কিন্তু একদিন পরেই মনে হয় তার ঔজ্জ্বল্য কমে এসেছে। মিথিলা চাদটির দিকে তাকিয়ে থাকে, তুই পাশে গহিন অরণ্য, সেখানে কোনো শব্দ নেই, কিন্তু তার মাঝে কত বিচিত্র প্রাণী তাদের জীবনকে তাদের নিজেদের মতো করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
মিথিলা নিঃশব্দে লঞ্চের ছাদে পায়চারী করতে থাকে। চাদটা যখন একটু ঢলে পড়ল তখন সে দেখতে পেল বিশাল একটা পাখির মতো ডানা মেলে বুলবুল লঞ্চটাকে ঘিরে বৃত্তাকারে ঘুরছে। ধীরে ধীরে বৃত্তটিকে ছোট করে নিঃশব্দে বুলবুল লঞ্চের ছাদে নেমে এল।
মিথিলা এগিয়ে গিয়ে বুলবুলের হাত ধরে বলল, তুমি এত দেরি করে এসেছ?
বুলবুল ফিসফিস করে বলল, আমি আরো আগে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু লঞ্চে মানুষজন জেগে আছে, চলাফেরা করছে; তাই দেরি হলো। কেউ আমাকে দেখে ফেললে কী বিপদ হবে জান?
মিথিলা মাথা নেড়ে বলল, জানি। বিপদ মনে হয় একটু হয়েছে।
কী বিপদ?
তোমার একটা পালক এইখানে খুঁজে পেয়েছে। সেইটা দেখে সবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সবাই বলছে, এত বড় পালক কোনো পাখির হতে পারে না।
সর্বনাশ!
হ্যাঁ। তোমাকে খুব সাবধান থাকতে হবে।
ঠিকই বলেছ।
তোমাকে যদি কেউ দেখে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
বুলবুল মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছ। সর্বনাশ হয়ে যাবে।
মিথিলা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমরা কাল সকালে চলে যাব।
চলে যাবে?
হ্যাঁ। আমার খুব মন খারাপ হবে।
বুলবুল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমারও।
মিথিলা বলল, আমার মনে হচ্ছে কেন তোমার সাথে দেখা হলো? দেখা না হলেই তো মন খারাপ হতো না।
বুলবুল মাথা নাড়ল, বলল, না। আমার সেটা মনে হচ্ছে না। আমার কী মনে হচ্ছে জান?