মিথিলার গলার স্বরে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ। বুলবুল একটু সরে গিয়ে মেয়েটিকে দেখার চেষ্টা করল। আজ ভোরে সে এই মেয়েটিকে লঞ্চের রেলিং ধরে বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। ডক্টর আশরাফ কঠিন গলায় বলল, আমি তো তোকে তোর মতোই থাকতে দিচ্ছি।
না আব্বু। তুমি আমাকে আমার মতো থাকতে দিচ্ছ না। তুমি। আমাকে বিরক্ত করছ।
মিথিলার কথা শুনে ডক্টর আশরাফ কেমন যেন ক্ষেপে গেল, চিৎকার করে বলল, আমি বিরক্ত করছি? যদি শুনতে পাই আমার মহারানী মেয়ে সারা দিন না খেয়ে বিছানায় শুয়ে ছিল, আমি যদি সেই খবর নিতে আসি, তাহলে সেটা বিরক্ত করা হয়?
হ্যাঁ আব্বু হয়। তোমার এটা আগে চিন্তা করা উচিত ছিল, আমার যখন খেতে ইচ্ছে করে না, আমি তখন খাই না। বাসায় তুমি সেটা জান না—কারণ তুমি বাসায় থাকো না।
ডক্টর আশরাফ কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না, তারপর থমথমে মুখে বলল, আমি কোনো টং দেখতে চাই না। খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর।
আমার খিদে নেই।
একজন মানুষ সারা দিন না খেয়ে থাকলে তার খিদে থাকে না কেমন করে?
আমি সেটা জানি না। কিন্তু আমার খিদে নেই।
আমাকে রাগাবি না, মিথিলা। আমি অনেক সহ্য করেছি।
কেন আব্বু? তুমি কী করবে? তুমি কি আমাকে মারবে নাকি?
দিন রাত মুখটাকে এমন ভেঁতা করে রাখবি—তোকে তো মারাই উচিত। কখনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারাটাকে একবার দেখেছিস?
মিথিলা ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, আই অ্যাম সরি আব্বু, আমার চেহারাটা খারাপ। আম্মু তো মরে গেছে—তোমার আর ঝামেলা নাই। তোমার সুন্দরী একজন কলিগকে বিয়ে করো, তোমার বাচ্চাগুলোর চেহারা যেন ভালো হয়।,
কী বললি? কী বললি তুই? বলে ডক্টর আশিরাফ এগিয়ে গিয়ে তার মেয়ের গালে প্রচণ্ড জোরে একটা চড় মেরে বলল, তোর এত বড় সাহস? তুই আমার সাথে এভাবে কথা বলিস?
মিথিলা প্রস্তুত ছিল না, সে প্রায় হুঁমড়ি খেয়ে পড়ে গেল, কোনোমতে সে উঠে দাঁড়িয়ে এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে তার বাবার দিকে তাকায়। সে যতটুকু রাগ হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি অবাক হয়েছে। যতটুকু অবাক হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি দুঃখ পেয়েছে। তাকে দেখে মনে হয় সে যেন এখনো ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছে না। মিথিলা বিচিত্র একটা দৃষ্টিতে তার বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর ফিসফিস করে বলল, তুমি আমাকে মারতে পারলে আব্বু?
ডক্টর আশরাফ কোনো কথা না বলে হিংস্র চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। মিথিলা এবার ফিসফিস করে বলল, ঠিক আছে আব্বু। গুড বাই।
ডক্টর অশিরাফ তখনো রাগে কাঁপছিল, সে কেবিন থেকে বের হয়ে নিজের কেবিনে গিয়ে ঢুকে সশব্দে তার দরজা বন্ধ করে দিল।
বুলবুল নিজের ভেতরে এক ধরনের অপরাধবোধ অনুভব করে, তার মনে হতে থাকে এভাবে লুকিয়ে বাবা আর মেয়ের এ রকম ব্যক্তিগত একটা ঘটনা তার দেখা উচিত হয়নি। কত দিন সে কোনো মানুষ দেখে না, লুকিয়ে সে তাদের দেখতে এসেছিল। কিন্তু তাই বলে মানুষের এ রকম ব্যবহার? বাবার সাথে মেয়ের? মেয়ের সাথে বাবার?
বুলবুলের মনটা খারাপ হয়ে যায়, সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, ঠিক যখন সে উড়ে যাবে তখন হঠাৎ করে নিচে দরজা খোলার শব্দ হলো, বুলবুল তখন মাথা নিচু করে তাকালো। দেখতে পেল মিথিলা তার কেবিন থেকে বের হয়ে এসেছে, ওপর থেকে তার মুখটা দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তার হাঁটার ভঙ্গিটুকু স্বাভাবিক নয়। অনেকটা অপ্রকৃতিস্থর মতো সামনে হেঁটে যায়। কয়েক মুহূর্ত রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর হঠাৎ সে রেলিংয়ের ওপর উঠে দাঁড়ায়, তারপর কিছু বোঝার আগেই সে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বুলবুল কিছু চিন্তা করার সময় পেল না, সে ঠিক একই গতিতে ছাদ। থেকে লাফিয়ে পড়ল এবং মির্থিলা নদীর পানি স্পর্শ করার আগের মুহূর্তে তাকে খপ করে ধরে ফেলল। তারপর তার বিশাল ডানা ঝাঁপটে সে উড়ে আসে, বৃত্তাকারে ঘুরে সে লঞ্চের ছাদে ফিরে এসে সাবধানে তাকে ছাদে নামিয়ে দিল।
মিথিলার কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে এবং শেষ পর্যন্ত সে বুঝতে পারে যে আসলে সে পানিতে ড়ুবে যায়নি, একেবারে শেষ মুহূর্তে তাকে কেউ ধরে ফেলেছে, তাকে নিরাপদে ছাদে নামিয়ে দিয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব মিথিলা কোনোভাবেই বুঝতে পারছিল না, সে হকচকিত হয়ে তখনো তাকিয়ে ছিল। জোছনার আলোতে সে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে, সামনে বিস্ময়কর একটি মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে, মানুষের মতো কিন্তু মানুষ নয়—কারণ সে জোছনার আলোতে স্পষ্ট দেখতে পারছে তার বিশাল দুটি পাখা। মিথিলা কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, তুমি কে?
বুলবুল কোনো উত্তর দিল না। সে কী উত্তর দেবে? সে কী বলবে, আমার নাম বুলবুল? আমি একই সাথে মানুষ এবং পাখি। আমি এই বনে একা একা উড়ে বেড়াই? সে কেমন করে এই মেয়েটিকে বলবে সে কে?
মিথিলা আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? তুমি কেন আমাকে বাঁচিয়েছ?
বুলবুল তখনো নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে। মিথিলা আরেকটু এগিয়ে এসে বুলবুলকে আরেকটু কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করে। তারপর ফিসফিস করে বলে, তুমি কি মানুষ?
বুলবুল এবার একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি না।
তুমি জান না?
বুলবুল মাথা নাড়ে। না।
মিথিলা তার হাতটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বুলবুলকে স্পর্শ করে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন আমাকে বাঁচিয়েছ?
আমার মা একদিন তোমার মতো পানিতে লাফ দিয়েছিল। তখন একজন তাকে বাঁচিয়েছিল, সেই জন্যে আমি এখনো আছি। বুলবুল নিচু গলায় বলল, একদিন তুমিও কারো মা হবে। বেঁচে না থাকলে কেমন করে হবে?