বুলবুলের মনে আছে সে জিজ্ঞেস করেছিল, বাবা, আমি কি মানুষ?
জহুর এক মুহূর্তের জন্যে থতমত খেয়ে বলেছিল, যার শরীরে এক ফোঁটাও মানুষের রক্ত থাকে সেই মানুষ।
বুলবুল ভেবেছিল সে তখন জিজ্ঞেস করবে, তাহলে আমি কেন মানুষের সাথে থাকতে পারি না? কিন্তু সে সেটা জিজ্ঞেস করেনি। জিজ্ঞেস করলে জহুর কষ্ট পাবে, সে জন্যে জিজ্ঞেস করেনি। সে কখনোই জহুরকে কষ্ট দিতে চায়নি।
বুলবুল হেঁটে হেঁটে খালের কিনারায় এল। জোয়ারের সময় খালটা পানিতে কানায় কানায় ভরে যায়। এখন ভাটির টান এসেছে, খালটার পানি বলতে গেলে নেই। বুলবুল খালের কিনারায় খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে সেখানে কিছু ফুলগাছ লাগিয়েছে—হরিণেরা এসে মাঝে মাঝেই ফুলসহ তার গাছ খেয়ে যায়—বুলবুল অবশ্যি কিছু মনে করে না। এই জঙ্গলে কোনো কিছুই কারো জন্যে নির্দিষ্ট নয়। সবকিছুই সবার জন্যে। বুলবুল তার ফুলগাছগুলো দেখে আরেকটু সামনে তার বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ দেখতে পেল। জহুর তাকে এটা শিখিয়েছিল। জহুর নাকি শিখেছিল একজন ডাকাতের কাছে। সেই ডাকাত জঙ্গলে লুকিয়ে ছিল বারো বছর, জঙ্গলে কেমন করে বেঁচে থাকতে হয় সে তার সব কায়দাকানুন জানত।
বুলবুলের বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের নিয়মটা খুব সোজা। মাটির মাঝে গর্ত করে তার উপরে একটা প্লাস্টিক বিছিয়ে রাখা! মাটি থেকে যে জলীয় বাষ্প বের হয় সেটা প্লাস্টিকের ওপর একত্র হয়ে ফোটা ফোটা করে ছোট একটা পাত্রে জমা হয়। জঙ্গলের বুনো একটা গাছের শক্ত খোেল দিয়ে সে বাটি বানিয়েছে। সেই বাটিতে এই পানি জমা হয়। বুলবুল বাটি বের করে ঢকঢক করে পানিটা খেয়ে আবার ঠিক জায়গায় রেখে দেয়। এই বিশুদ্ধ পানি না হলেও তার আজকাল অসুবিধা হয় না, সে নদীর নোনাপানিও খেতে পারে। শুধু নোনাপানি নয়, সে যা কিছু খেতে পারে তার কখনো শরীর খারাপ হয় না। জীবনে তার জ্বর হয়নি, সর্দি কাশি কিছু হয়নি। তার শরীর কেটে গেলেও কখনো ইনফেকশন হয় না। জহুর দেখে দেখে অবাক হয়ে বলত, আমার কী মনে হয় জানিস?
কী বাবা?
তোর শরীরটা নিশ্চয়ই অন্য রকম কিছু দিয়ে তৈরি। তাই রোগজীবাণু তোকে ধরে না। তোর অসুখ হয় না।
বুলবুল বলত, অসুখ হলে কেমন লাগে বাবা?
জহুর হাসার চেষ্টা করে বলত, সেটা জানিস না খুব ভালো কথা। জানার জন্যে এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন?
জহুরের শেষের দিকে খুব অসুখ হতো। এই জঙ্গলে তার শরীরটা টিকত না, খুব অসুস্থ হয়ে সে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকত। গভীর রাতে বুলবুলের যখন ঘুম ভাঙত সে দেখত ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে জহুর তার দিকে তাকিয়ে আছে। বুলবুল ঘুম ঘুম গলায় জিজ্ঞেস করত, কী দেখো বাবা?
জহুর নিঃশ্বাস ফেলে বলত, তোকে দেখি।
আমাকে কী দেখো?
কাজটা ঠিক করলাম কি না সেটা দেখি।
কোন কাজটা বাবা?
এই যে তোকে ছোটবেলা বাঁচিয়ে তুলেছি। বাঁচিয়ে তুলে কি ভুল করলাম? তোর মায়ের সাথে তোকেও কি চলে যেতে দেয়া উচিত ছিল?
বুলবুল তখন বলে, না বাবা। ভুল করোনি।
ঠিক বলছিস? তোকে বাঁচিয়ে রেখে শুধু কি কষ্ট দিচ্ছি?
না বাবা। মোটেও কষ্ট দাওনি। তুমি খুব ভালো কাজ করেছ।
আর এখন? এই জঙ্গলে? একা একা?
এটা সবচেয়ে ভালো হয়েছে বাবা। আমি একেবারে স্বাধীনভাবে উড়তে পারি, ঘুরতে পারি!
জহুর ইতস্তত করে বলত, তুই যে একা!
কে বলেছে একা? এই তো তুমি আছ?
জহুর নিঃশ্বাস ফেলে বলত, আমি আর কদিন। আমি টের পাচ্ছি আমার ডাক এসেছে।
বুলবুল বুঝতে পারেনি সত্যি সত্যি তার ডাক এসেছে। একদিন ভোরবেলা জহুঁ বলল, বাবা বুলবুল।
বুলবুল বলল, কী বাবা।
জহুর বলল, আজকে খুব একটা বিশেষ দিন।
কেন বাবা? আজকে আমি যাব।
কোথায় যাবে বাবা?
জহুর হাসার চেষ্টা করে বলল, যেখান থেকে ডাক এসেছে, সেখানে।
বুলবুল চমকে উঠে বলেছিল, না বাবা।
জহুর বলেছিল, হ্যাঁ। তারপর তার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিল, আয় আমাকে সাহায্য কর।
বুলবুল তখন চোখ মুছে তাকে সাহায্য করেছিল। খালের মাঝে যে নৌকাটা ছিল, জহুর সেই নৌকাটার মাঝে গিয়ে শুয়েছিল। বুলবুলকে বলেছিল, বাবা নৌকার লগি দিয়ে একটা ধাক্কা দে।
বুলবুল লগি দিয়ে নৌকাটাকে ধাক্কা দিতেই সেটা খালের মাঝখানে চলে এল। ভাটির টানে সেটা তরতর করে এগুতে থাকে। জহুর চিৎ হয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থেকে ফিসফিস করে বলল, নৌকাটা খাল থেকে যাবে নদীতে, নদী থেকে যাবে সমুদ্রে। সমুদ্রে যেতে যেতে আমি আর থাকব না।
বুলবুল জহুরের হাত ধরে থাকল, জহুর কলল, একটু পরে আমি আর কথা বলতে পারব না, তখন তুই চলে যাস বাবা।
বুলবুল বলল, না বাবা, আমি যেতে চাই না।
তোকে যেতে হবে। কেউ সারা জীবন থাকে না। একদিন তুইও থাকবি না।
না বাবা–
না বলে না বোকা ছেলে। নৌকাটা বেশি দূরে যাবার আগে তুই চলে যাবি। সমুদ্রে জেলে নৌকা থাকে, তাকে পরে দেখে ফেলবে।
বুলবুল কোনো কথা বলল না। জহুর বলল, তুই আমাকে মাপ করে দিস বাবা, তোকে আমি সুন্দর একটা জীবন দিতে পারলাম না।
বুলবুল বলল, তুমি আমাকে অনেক সুন্দর জীবন দিয়েছ।
তুই তো একা একা থাকবি, কিন্তু তাই বলে তুই কিন্তু বন্য হয়ে যাবি।
হব না।
তোকে যেন কোনো দিন কোনো মানুষ খুঁজে না পায়। কিন্তু যদি কখনো পেয়ে যায় তাহলে তুই কিন্তু খুব সাহসী মানুষ হবি। খুব ভালো মানুষ হবি। খুব হৃদয়বান মানুষ হবি।
হব।
হৃদয়বান আর দয়ালু।
হব বাবা।