নাহ্। গ্রামে মানুষ হয়েছি, চাষ বাস করেছি। লেখাপড়ার দরকার হয় নাই, করিও নাই। পত্রিকাটা কোনোমতে পড়তে পারি। পত্রিকায় যে সব খবর থাকে এখন মনে হয় ওইটা না পড়তে পারলেই ভালো ছিল।
অ। মানুষটা এবারে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বেশি লেখাপড়া জানা মানুষেরও চাকরি আছে।
জহুর একটু উৎসাহ দেখানোর ভান করে বলল, আছে নাকি?
জি। আছে।
সেটা কী চাকরি?
এই মনে করেন কেয়ারটেকারের চাকরি।
জহুর একটু হাসার ভঙ্গি করল, বলল, তার মানে দারোয়ানের চাকরি?
মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, সেটা আপনার ইচ্ছে হলে বলতে পারেন। চাকরি হচ্ছে চাকরি। দারোয়ানের চাকরিও চাকরি কেয়ারটেকারের চাকরিও চাকরি।
জহুর নিঃশ্বাস ফেলে বলল, নাহ্ ভাই। এই বয়সে আর দারোয়ানের চাকরি করার কোনো ইচ্ছা নাই।
তাহলে অন্য চাকরিও আছে—
জহুর এবারে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, নাহ্।
কেন না?
জহুর মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আসলে ভাই আপনি যে রকম হাইফাই হাসপাতালের বর্ণনা দিলেন, আমার সেই রকম হাসপাতালে চাকরি করার কোনো ইচ্ছা নাই। আমি মনে করেন চাষা মানুষ, বড়লোক সে রকম দেখি নাই। দেখার ইচ্ছাও নাই। এই রকম বড়লোকদের চাকর-বাকরের কাজ করার ইচ্ছা করে না।
মাঝবয়সী মানুষটা কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বুঝেছি। আপনি কী বলতে চাচ্ছেন বুঝেছি। আপনি যে রকম করে ভাবেন আমিও সেই রকম করে ভাবি। তবে–
তবে কী?
আপনি চাকরি করতে না চাইলে নাই। তবে আমি বলি কী—আপনি হাসপাতালটা একটু দেখে আসেন।
জহুর একটু অবাক হয়ে বলল, দেখে আসব?
জি। এটা একটা দেখার মতো জায়গা। কাদের স্যার যদি পাবলিকদের এটা দেখার জন্যে টিকেট সিস্টেম করতেন তাহলে মানুষ টিকেট কিনে দেখে আসত।
আচ্ছা!
জি। মানুষটা মাথা নাড়ে, বলে, আপনার চাকরি করার কোনো দরকার নাই। শুধু একটা ইন্টারভিউ দিয়ে আসেন। এই হাসপাতালটা দেখার মাত্র দুইটা উপায়। এক হচ্ছে রোগী হয়ে যাওয়া। আর দুই হচ্ছে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া।
জহুর কিছুক্ষণ মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি চাকরি না চাইলেও ইন্টারভিউ দিব?
কেন দিবেন না?
কীরকম করে দিব? কেমন করে যাব?
আমি আপনার যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব। জেটি থেকে সপ্তাহে দুই দিন একটা ট্রলার হাসপাতালে যায়।
জহুর মাথা নেড়ে বলল, না ভাই! আমার ইচ্ছা নাই।
কেন ইচ্ছা নাই? যে জায়গাটা মানুষ পয়সা দিয়েও দেখতে পারে না, আপনি সেটা ফ্রি দেখে আসবেন। যাতায়াত থাকা খাওয়া ফ্রি—
জহুর একটু হেসে ফেলল, বলল, ভাই আমি গরিব মানুষ কথা সত্যি। কিন্তু তাই বলে একটা কিছু ফ্রি হলেই আমি হামলে পড়ি না!
মানুষটা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আমি সেটা বলি নাই! আমি বলেছি জায়গাটা দেখে আসার জন্যে। এটা একটা দেখার মতো জায়গা।
জহুর কিছুক্ষণ মানুষটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আপনি সত্যি কথাটা বলেন দেখি। কেন আপনি আমাকে এত পাঠাতে চাইছেন। এখানে অন্য কোনো ব্যাপার আছে।
মানুষটা প্রতিবাদ করতে গিয়ে থেমে গিয়ে অপ্রস্তুতের মতো একটু হেসে ফেলল, হাসি থামিয়ে বলল, আমি আসলে এই হাসপাতালের একজন রিক্রুটিং এজেন্ট। যদি হাসপাতাল আমার সাপ্লাই দেয়া কোনো মানুষকে চাকরি দেয় তাহলে আমি একটা কমিশন পাই।
জহুর এবার বুঝে ফেলার ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল, বলল, এইবার বুঝতে পারলাম।
মানুষটা বলল, আপনাকে আমি কয়েকদিন থেকে লক্ষ করছি। চুপচাপ মানুষ, কোনোরকম হাঙ্গামা হুঁজ্জোতের মাঝে নাই। সেইদিন দেখলাম ওই পকেটমারকে পাবলিকের হাত থেকে বাঁচালেন। আপনি না থাকলে বেকুবটাকে পাবলিক পিটিয়ে মেরে ফেলত। কী ঠান্ডা মাথায় কাজটা করলেন, অসাধারণ! যখন পুলিশের সাথে কথা বললেন আপনার কোনো তাপ উত্তাপ নাই। আপনি রাগেন না—আপনি ভয়ও পান না। ঠান্ডা মানুষ।
জহুরের সেদিনের ঘটনাটা মনে পড়ল, সমুদ্রের তীরে পকেট মারতে গিয়ে কমবয়সী একটা ছেলে ধরা পড়ল। ভদ্রঘরের মানুষজন তখন তাকে কী মারটাই না মারল, সে গিয়ে না থামালে মেরেই ফেলত। লাশটা ফেলে রেখে সবাই সরে পড়ত। যেন মানুষের লাশ না, কুকুর বেড়ালের লাশ।
মানুষটা বলল, হাসপাতালটা আসলে আপনাদের মতো ঠান্ডা মানুষ। খোঁজে। আমার মনে হচ্ছিল আপনি ইন্টারভিউ দিলেই চাকরি পেয়ে যাবেন।
আর আমি চাকরি পেলেই আপনি কমিশন পাবেন?
অনেকটা সেই রকম।
জহুর এবার উঠে দাঁড়াল, বলল, ভাই আপনার এইবারের কমিশনটা গেল। চোখ কান খোলা রাখেন আর কাউকে পেয়ে যাবেন। দেশে আজকাল চাকরির খুব অভাব—
জহুরের সাথে সাথে মাঝবয়সী মানুষটাও উঠে দাঁড়াল, পকেট থেকে নীল রঙের একটা কার্ড বের করে জহুরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নেন ভাই। এইটা রাখেন।।
এইটা কী?
ইন্টারভিউ কার্ড। আপনি যদি মত পাল্টান তাহলে পরশু দিন জেটিতে আসেন। বড় ট্রলার, নাম হচ্ছে এম.ভি, শামস। কার্ড দেখালেই আপনাকে তুলে নেবে।
জহুর কার্ডটা হাতে নিয়ে বলল, আর যদি না আসি?
তাহলে কার্ডটা ছিঁড়ে ফেলে দিবেন—অন্য কাউকে দিবেন না।
ঠিক আছে। জহুর লম্বা পা ফেলে হাঁটতে শুরু করে, তখন পেছন থেকে মাঝবয়সী মানুষটা বলল, আরেকটা জিনিস বলতে ভুলে গেছি।
কী জিনিস?
আপনি যদি ইন্টারভিউ দিতে আসেন তাহলে কাদের স্যারের সাথে দেখা হবে। পৃথিবীতে এই রকম দুইটা মানুষ নাই।
কেন?
সেইটা বলে বোঝানো যাবে না—আপনার নিজের চোখে দেখতে হবে। স্যার নিজে সবার ইন্টারভিউ নেন। মালী থেকে শুরু করে সার্জন—সবার।