মানুষগুলো যখন আরেকটু এগিয়ে আসে তখন বুলবুল হঠাৎ হাঁটু ভাজ করে নিচু হয়ে উপরে লাফ দেয় এবং প্রায় সাথে সাথে তার পাখা দুটি ঝাঁপটা দিয়ে ওঠে।
ভাইকে কোলে নিয়ে লিপি, তার স্কুলের বন্ধুরা, মালবিকা এবং বন্দুক হাতের মানুষগুলো অবাক হয়ে দেখল বিশাল একটা পাখির মতো বুলবুল আকাশে উড়ে যাচ্ছে!
মোটা ঘাড়ের মানুষটা চিৎকার করে বলল, ধর! ধর!
তার কথা শুনে মানুষগুলো লাফিয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করে কিন্তু ততক্ষণে বুলবুল অনেক উপরে উঠে গেছে। মোটা ঘাড়ের মানুষটা চিৎকার করে বলল, গুলি কর! গুলি!
বন্দুক হাতের মানুষটা বন্দুকটা তুলে বুলবুলের দিকে তাক করে। ঠিক যখন সে ট্রিগারটা টেনে ধরবে তখন কোথা থেকে জানি লিপি ছুটে এসে বন্দুক হাতের মানুষটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে। প্রচণ্ড গুলির শব্দে পুরো এলাকাটা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে কিন্তু অল্পের জন্যে গুলিটা বুলবুলের গায়ে না লেগে ফস্কে গেল।
এক সাথে কয়েকজন এসে লিপিকে ধরে টেনে ছুড়ে ফেলে দেয়, ছোট ভাইটা কোল থেকে পড়ে গিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। বন্দুক হাতের মানুষটা আবার আকাশের দিকে তার বন্দুকটা তাক করল তখন ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা স্কুলের ছেলেগুলো এসে সেই মানুষটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, দ্বিতীয় গুলিটাও তাই লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। ততক্ষণে বুলবুল অনেক দূরে সরে গেছে।
সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে, পাখা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে বিশাল একটা পাখির মতো বুলবুল উড়ে যাচ্ছে। ভোরের সূর্যের আলো পড়ে তার পাখা দুটো চিকচিক করছে।
জহুরের সামনে ডক্টর সেলিম কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচণ্ড ক্রোধে তার মুখটা খানিকটা বিকৃত হয়ে আছে। সে মাটিতে পা দাপিয়ে বলল, কোথায় গেছে? বল কোথায় গেছে?
জহুর খুব বেশি হাসে না। এবারে সে মুখে জোর করে একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, আপনার ধারণা আমি আপনাকে বলব সে কোথায় গেছে?
ডক্টর সেলিম চোখ লাল করে বলল, তোমাকে আমি খুন করে ফেলব।
জহুর কষ্ট করে মুখে হাসি ধরে রেখে বলল, বরং সেইটাই করে ফেলেন! আপনার জন্যে সেইটা কঠিন না, তিন সপ্তাহের বাচ্চাকে যে খুন। করতে পারে আমার মতো বুড়া হাবড়াকে খুন করতে তার কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না।
তুমি ভাবছ আমি মশকরা করছি? নী। আমি সেটা ভাবছি না। তবে তবে কী?
চরের মানুষেরা কিন্তু খুব ডেঞ্জারাস। আমাকে খুন করতে চাইলে আরো মানুষের ভিড় হওয়ার আগে করে ফেলেন। তারপর তাড়াতাড়ি পালান। তা না হলে এই চরের মানুষেরা কিন্তু আপনাদের সবাইকে চরের বালুর মাঝে পুঁতে ফেলতে পারে। বাইরের মানুষ খবরও পাবে না।
ডক্টর সেলিম হঠাৎ করে একটু চঞ্চল হয়ে ওঠে। সে চোখের কোনা দিয়ে তাকায়, সত্যি সত্যি পাথরের মতো মুখ করে মানুষজন একটু দূরে দাঁড়িয়ে স্থির চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ডক্টর সেলিম আবার জহুরের দিকে তাকালো, তারপর দাতে দাঁত ঘষে বলল, তুমি আমার প্রাইজটা নিয়ে একবার পালিয়েছ! আমার দশ বছর লেগেছে তোমাকে খুঁজে বের করতে! আমি আবার তোমাকে আর তোমার চিড়িয়াকে খুঁজে বের। করব।
আরো দশ বছর পর? জহুর আবারো সত্যি সত্যি হেসে ফেলল, বলল, দশ বছরে আমার ছোট বুলবুল একটা জওয়ান মানুষ হবে। তখন আমাকে আর তাকে দেখে রাখতে হবে না, আমার বুলবুল নিজেই তোমার ঘাড়টা কটাস করে ভেঙে দেবে।
ডক্টর সেলিম বিস্ফারিত চোখে জহুরের দিকে তাকিয়ে রইল। পাশে দাঁড়ানো মোটা ঘাড়ের মানুষটা রিভলবারের বাঁট উঁচু করে জহুরের মাথায় মারার জন্যে এগিয়ে আসছিল, ডক্টর সেলিম তাকে থামাল। নিচু গলায় বলল, এখন ঝামেলা করো না। ঘাটে চলো।
নদীর ঘাটে পৌঁছানোর আগেই তারা দেখতে পায় তাদের স্পিডবোটটি দাউ দাউ করে জ্বলছে। কিছু মানুষ তাদের বোটটা জ্বালিয়ে দিয়েছে, পেট্রোলের ট্যাংকটা তাদের চোখের সামনেই সশব্দে ফেটে গেল। মাথা ঘুরিয়ে তারা তীরের দিকে তাকালো, দেখল চরের মানুষজন আস্তে। আস্তে ঘাটের দিকে আসছে। সবার সামনে হালকা পাতলা ছোট একটা মেয়ে, কোলে ছোট একটা বাচ্চা।
অনেক দূর থেকেই ডক্টর সেলিম ছোট মেয়েটির চোখের প্রবল ঘৃণাটুকু বুঝতে পারে। সে ঘুরে কাঁপা গলায় বলল, বন্দুকে গুলি আছে তো?
আছে।
কতগুলো।
যথেষ্ট।
ডক্টর সেলিম দরদর করে ঘামতে থাকে, সে ঠিক বুঝতে পারছিল না ঠিক কতগুলো গুলি হলে সেটাকে যথেষ্ট বলা যাবে।
২.৫ নৌকাটাকে টেনে উপরে তুলে
নৌকাটাকে টেনে উপরে তুলে জহুর চাঁদের আলোতে তীরে উঠে এলো। চাপা গলায় ডাকল, বুলবুল!
নির্জন চরে তার গলার স্বর অনেক দূর পর্যন্ত ভেসে যায়। কোনো উত্তর না পেয়ে সে আবার ডাকল, এবার আরেকটু গলা উঁচিয়ে, বুলবুল!
একটু দূরে বড় একটা ঝাঁপড়া গাছের ওপর কিছু একটা নড়ে ওঠে, সেখান থেকে অতিকায় একটা পাখির মতো ভেসে ভেসে বুলবুল নামতে থাকে, জহুরের মাথার ওপর দুই পাক ঘুরে সে নিচে নেমে আসে। তারপর ছুটে জহুরের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, বাবা! এসেছ?
হ্যাঁ বাবা। এসেছি।
এত দেরি করলে কেন?
দেরি করি নাই বাবা। আমি এর আগে আসতে পারতাম না। তোকে নিয়ে কত হইচই হয়েছে জানিস? শহর থেকে কত সাংবাদিক এসেছে। টেলিভিশন ক্যামেরা এসেছে। সবাই আমাকে চোখে চোখে রাখছে। তাই আমি ঘর থেকে বের হই নাই। বলেছি তুই কোথায় গেছিস আমি জানি না। যখন সবার উত্তেজনা কমেছে, সবাই চলে গেছে তখন এসেছি।