জহুর জিজ্ঞেস করল, স্যারটা কে?
ঘাড় মোটা মানুষটা বলল, সেটা শুনে তুমি কী করবে?
ডক্টর সেলিম?
হঠাৎ করে ঘাড় মোটা মানুষটা বলল, চুপ কর। চুপ কর তুমি। তা না হলে খুন করে ফেলব।
জহুর চুপ করে গেল। আনোয়ারা জহুরের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, এখন কী হবে জহুর?
জহুর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আল্লাহ যেটা ঠিক করে রেখেছে সেটাই হবে।
ঠিক সেই সময় মালবিকা ছোট স্কুলঘরের তালা খুলে দিয়েছে এবং স্কুলের ছেলেমেয়েরা ভেতরে ঢুকে টানাটানি করে হোগলার মাদুরটা বিছিয়ে দিতে শুরু করেছে। কয়েকজন বইপত্র সামনে রাখতে শুরু করে দিল। লিপি তার ছোট ভাইটাকে মাটিতে বসিয়ে তখন জানালাটা খুলে দেয় এবং বাইরে তাকিয়ে উৎফুল মুখে বলল, স্কুলে সাহেবরা আসছে।
যে প্রতিষ্ঠানটা এই স্কুলটি এখানে বাসিয়েছে মাঝে মাঝে তাদের কর্মকর্তারা এটা দেখতে আসে, যখনই আসে তখনই তারা বাচ্চাদের জন্যে খাতাপত্র বা গুঁড়োদুধ নিয়ে আসে। কাজেই সাহেবরা স্কুল দেখতে আসছে সেটা নিঃসন্দেহে সবার জন্যে একটা আনন্দ সংবাদ।
মালবিকা অবাক হয়ে বলল, নাহ! আজকে তো কারো আসার কথা না!
আসছে আপা, এই দেখেন।
মালবিকা জানালায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, আরে! মানুষগুলোর হাতে বন্দুক! ব্যাপার কী?
একটা ছেলের চোখ আনন্দে চকচক করে ওঠে, মনে হয় পাখি শিকার করতে এসেছে!
চল দেখি— বলে কিছু বলার আগেই বাচ্চাগুলো দৌড়ে বের হয়ে যায়। মালবিকা তাদের থামানোর জন্যে একটু চেষ্টা করল কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে, সবাই ছুটতে ছুটতে পাখিশিকারি দেখতে বের হয়ে গেছে। মালবিকা বাচ্চাগুলোকে ফিরিয়ে আনার জন্যে পেছনে পেছনে বের হয়ে গেল।
লিপির পাশে দাঁড়িয়ে বুলবুল বাইরে তাকালো এবং হঠাৎ করে তার বুকটা ধ্বক করে ওঠে। কেউ বলে দেয়নি কিন্তু হঠাৎ করে সে বুঝে গেল এই মানুষগুলো আসলে তাকেই ধরতে আসছে। জহুর কয়েক দিন থেকে তাকে এই বিষয়টা নিয়েই সতর্ক করে আসছিল।
বুলবুল নিচু গলায় লিপিকে বলল, এই মানুষগুলো পাখি শিকার করতে আসে নাই।
লিপি জিজ্ঞেস করল, তাহলে কী শিকার করতে এসেছে?
আমাকে।
তোকে? লিপি অবাক হয়ে বলল, তোকে কেন?
বুলবুল লিপির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, লিপি! তুই একটা কাজ করতে পারবি?
কী কাজ?
বুলবুল তার শার্টটা ততক্ষণে খুলে ফেলেছে, লিপি অবাক হয়ে দেখল শার্টের নিচে কাপড় দিয়ে তার শরীরটা পেঁচানো—পেছনের দিকে খানিকটা উঁচু হয়ে আছে। বুলবুল বলল, আমার এই কাপড়টা খুলে দিবি? তাড়াতাড়ি?
কেন? কাপড় দিয়ে বেঁধে রেখেছিস কেন?
আগে খুলে দে তাহলেই বুঝবি—
লিপি কাপড়ের বাঁধন ঢিলে করতেই বুলবুল ঘুরে ঘুরে পেঁচানো কাপড় খুলতে থাকে এবং দেখতে দেখতে তার পেছনের পাখা বের হয়ে আসে। লিপি ফ্যালফ্যাল করে বুলবুলের দিকে তাকিয়ে থাকে, অনেক কষ্ট করে বলে, তুই-তুই–
হ্যাঁ। লিপি তোকে বলেছিলাম না ছেলে পরীর কথা? আমি ছেলে পরী—।
লিপি আবার বলল, তুই তুই তুই—
হ্যাঁ আমি। ঐ মানুষগুলো আমাকে ধরতে আসছে।
তোর পাখা আছে? আসলে তুই কুঁজা না?
না আমি কুঁজা না। আমার পাখা আছে।
তুই উড়তে পারিস?
হ্যাঁ আমি উড়তে পারি। ঐ মানুষগুলো যখন আমাকে ধরতে আসবে তখন আমি উড়ে যাব।
সত্যি? উড়ে কোথায় যাবি।
জানি না।
আর কোনো দিন আসবি না?
বুলবুল একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কেমন করে আসব? এখন তো সবাই জেনে যাবে আমি আসলে মানুষ না। হঠাৎ করে বুলবুলের মুখটাকে করুণ এবং বিষণ্ণ মনে হয়।
লিপি কিছুক্ষণ বুলবুলের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, তুই তাহলে কী?
আমি জানি না। আমি যদি মানুষ হতাম তাহলে কি কেউ কোনো দিন আমাকে ধরে নিতে আসত?
লিপি অবাক হয়ে বুলবুলের দিকে তাকিয়ে থাকে, আস্তে করে তার পাখায় হাত বুলিয়ে বিস্ময়ের গলায় বলল, কি সুন্দর!
সুন্দর?
হ্যাঁ। সুন্দর। লিপি আস্তে আস্তে বলল, তুই আগে কেন কোনো দিন আমাকে বললি না?
যদি সবাই জেনে যেত?
লিপি মাথা নেড়ে বলল, আমি কাউকে বলতাম না।
সত্যি?
সত্যি।
বুলবুল একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি বুঝি নাই। যদি বুঝতাম তাহলে বলতাম।
লিপি আবার মাথা নাড়ল, বলল, বলতাম না। কাউকে বলতাম না।
বুলবুল জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে বলল, মানুষগুলো এসে গেছে।
হ্যাঁ।
আমি এবারে জানালা দিয়ে বাইরে যাব। ঠিক আছে?
ঠিক আছে।
জানালাটা অনেক উপরে, বুলবুল হাত দিয়ে ধরে যখন ওঠার চেষ্টা। করল তখন লিপি তাকে ধাক্কা দিয়ে সাহায্য করল। সে অবাক হয়ে দেখল। বুলবুলের শরীরটা পাখির পালকের মতো হালকা।
বুলবুল জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়ার সাথে সাথে মানুষগুলো ঘরের ভেতরে এসে ঢুকল। ঘাড় মোটা মানুষটা বলল, কোথায়? বুলবুল কোথায়?
লিপি কথার কোনো উত্তর দিল না। তার ছোট ভাইটাকে মাটি থেকে কোলে তুলে নিল। মানুষটা তখন ধমক দিয়ে বলল, কোথায়?
লিপি বলল, নাই।
নাই মানে? কোথায় গেছে?
আমি জানি না।
মানুষগুলো অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে লিপির দিকে তাকিয়ে থাকে। একজন জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো, তারপরেই চিৎকার করে বলল, বাইরে। বাইরে। কুইক।
সবাই বাইরে ছুটে যায় এবং সেখানে তারা একটা অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখতে পায়। মাঠের মাঝখানে বুলবুল খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার পেছন থেকে পাখির ডানার মতো দুটি ভানা বের হয়ে এসেছে। বুলবুলের চেহারায় এক ধরনের বিষণ্ণতার ছাপ, সে যেন অনেকটা অন্যমনস্কভাবে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষগুলো তাদের বন্দুক উদ্যত করে বুলবুলকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করল, বুলবুলকে সেটা নিয়ে খুব চিন্তিত মনে হলো না।