ঠিক এ রকম সময় খুব ভোরে চরের ঘাটে একটা স্পিডবোট এসে থামল এবং সেখান থেকে বেশ কয়েকজন মানুষ তীরে নেমে এল। সবার শেষে যে নেমে এল সে হচ্ছে ডক্টর সেলিম। সে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একজন শুকনো মানুষকে জিজ্ঞেস করল, এইটা সেই চর?
শুকনো মানুষটি বলল, জি স্যার।
এইখানে পাখাওয়ালা বাচ্চাটাকে দেখা গেছে?
জি স্যার।
বাচ্চাটাকে খুঁজে বের করা হয়েছে?
জি স্যার। জহুর নামে একটা মানুষের বাচ্চা—
জহুর! হ্যাঁ জহুর, ঠিকই বলেছে—মানুষটার নাম ছিল জহুর। এই জহুরের কাছে বাচ্চাটা থাকে?
হ্যাঁ। জহুরকে বাবা ডাকে।
বাচ্চাটার পাখা—
পাখাটা ঢেকে রাখে মনে হয়। পিঠের দিকে উঁচু হয়ে থাকে, সবাই মনে করে কুঁজো। বাচ্চাকে কুঁজা বুলবুল ডাকে।
ডক্টর সেলিমের মুখে হাসি ফুটে ওঠে, মাথা নেড়ে বলে, চমৎকার। আমার হাত থেকে পালাবে ভেবেছিলে? কোথায় পালাবে সোনার চাদ।
জি স্যার। এখন আর পালানোর কোনো উপায় নেই।
ডক্টর সেলিম তার ছোট দলটাকে ডাকে, শোনো তোমরা সবাই।
মানুষগুলো ডক্টর সেলিমকে ঘিরে দাঁড়াল। ডক্টর সেলিম বলল, এইটা খুবই ছোট একটা চর, মানুষজন বেশি নাই। আমরা যে এসেছি সেই খবরটা দেখতে দেখতে ছড়িয়ে যাবে। খবর ছড়িয়ে গেলেই ঝামেলা, জহুর নামের মানুষটা অসম্ভব ডেঞ্জারাস। কোনো কিছুতে ঘাবড়ায় না—কাজেই সে যদি আমাদের খবর পায় তাহলে বিপদ হতে পারে। তাকে প্রথম আটকাও।
ঘাড় মোটা একজন মানুষ বলল, আটকাব।
শোনো—আগেরবার বাচ্চাটা আমার হাত ফসকে পালিয়ে গেছে। এইবার যেন কিছুতেই না পালায়। জহুরকে আটকাতে হবে। দরকার হলে গুলি করো—পুলিশকে আমি সামলাব।
ঘাড় মোটা মানুষটা বলল, আপনি চিন্তা করবেন না।
জহুরকে আটকানোর পর খুঁজে বের করো ছেলেটা কোথায় আছে। ধরে নিয়ে আসো এই স্পিডবোটে, কেউ কিছু বোঝার আগে নিয়ে চলে যাব।
ঘাড় মোটা মানুষটির সাথে সাথে আরো দুজন বলল, ঠিক আছে স্যার।
ডক্টর সেলিম মুখ শক্ত করে বলল, শোনো। বাচ্চাটাকে জীবন্ত ধরতে হবে। জীবন্ত। মনে থাকবে?
মনে থাকবে।
কিন্তু যদি তোমরা দেখো তাকে জীবন্ত ধরতে পারছ না, সে উড়ে পালিয়ে যাচ্ছে তাহলে তাকে মৃত হলেও ধরতে হবে। বুঝেছ?
বুঝেছি। জীবিত অথবা মৃত।
না। ডক্টর সেলিম মাথা নাড়ল, জীবিত অথবা মৃত না। জীবিত এবং জীবিত। কিন্তু যদি দেখা যায় কোনোভাবেই তাকে জীবিত ধরা যাচ্ছে না, তাহলে মৃত। বুঝেছ?
বুঝেছি।
ঠিক আছে। কাজে লেগে যাও।
জহুরকে চারজন মানুষ যখন আটক করল তখন সে তার আলকাতরার কৌটা নিয়ে নদীর ঘাটে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তার নৌকাটা অনেক দিন থেকে মেরামত করা হয়নি, সে কয়েক দিন আগে টেনে তীরে তুলে এনেছে। এত দিনে সেটা শুকিয়ে গেছে, আজ আলকাতরা দিয়ে লেপ দেয়ার কথা। সে অবশ্যি বাড়ি থেকে বের হতে পারল না, তার আগেই তাকে আটক করা হলো। জহুর প্রস্তুত ছিল না, হঠাৎ করেই দেখল তার সামনে দুজন এবং পেছনে দুজন মানুষ। সে তার পিঠে একটা ধাতব নলের খোঁচা অনুভব করে, শুনতে পায় একজন বলছে, যদি তুমি কোনো তেড়িবেড়ি করো তাহলে গুলি করে দেব।
জহুর কীভাবে কীভাবে জানি বুঝে গেল মানুষটা দরকার হলে সত্যিই গুলি করে দেবে, তাই সে নড়ল না। সে হঠাৎ করে তার বুকের মাঝে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে, বুক আগলে সে যে শিশুটিকে বড় করেছে আজকে তার খুব বিপদের দিন। বাচ্চাটি পারবে নিজেকে রক্ষা করতে?
জহুর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমরা কী চাও?
তুমি খুব ভালো করে জান, আমরা কী চাই। তোমরা কারা?
পেছনের মানুষটি তার পেছনে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, তোমার বাবা।
জহুর বলল, অ।
মানুষগুলো জহুরকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল, তারপর একজন জিজ্ঞেস করল, চিড়িয়াটা কই?
বুলবুলের কথা জানতে চাইছ?
হ্যাঁ।
বুলবুল চিড়িয়া না। সে খুব ভালো একটা ছেলে। আমি তাকে বুকে ধরে মানুষ করেছি।
মানুষটি হাতের রিভলবারটা ঝাকুনি দিয়ে বলল, তুমি বুকে ধরে মানুষ করেছ না ইয়েতে ধরে মানুষ করেছ, আমরা সেটা জানতে চাই না। আমরা জানতে চাই সে কোথায়?
জহুর একটা নিঃশ্বাস ফেলে, আগে তোক পরে হোক তারা খোঁজ পেয়ে যাবেই বুলবুল কোথায়। এই রকম সময় সে স্কুলে থাকে। কিন্তু কথাটা সে সরাসরি বলতে চায় না। যদি একটু হইচই হয় একটু গোলাগুলি হয় বুলবুল সেটা শুনতে পেয়ে সতর্ক হতে পারবে। জহুর বলল, আমি বলব না।
ঘাড় মোটা মানুষটা বলল, তুমি বলবে না? তোমার বাবায় বলবে।
জহুর শীতল চোখে বলল, ঠিক আছে। তুমি তাহলে আমার বাবাকেই জিজ্ঞেস করো।
রিভলবার হাতের মানুষটা তার রিভলবারের বাঁট দিয়ে মাথায় মারতে যাচ্ছিল, ঘাড় মোটা মানুষটা তাকে থামাল, বলল, আগেই মারপিট দরকার নেই। না বলে যাবে কোথায়, সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে বাঁকা করতে হবে।
ঠিক এ রকম সময় একজন মানুষ আনোয়ারাকে টেনে এনে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে বলল, খবর পাওয়া গেছে।
পাওয়া গেছে?
হ্যাঁ। মানুষটা বলল, আমাদের চিড়িয়া স্কুলে গেছে।
চিড়িয়া আবার স্কুলেও পড়ে নাকি?
হ্যাঁ। চিড়িয়া লেখাপড়া শিখে জজ ব্যারিস্টার হবে।
কথাটি যেন অত্যন্ত উঁচু দরের রসিকতা এ রকম ভান করে সবাই হ্যাঁ। হা করে হাসতে থাকে। ঘাড় মোটা মানুষটা বলল, হাসি থামা। এই মেয়েলোকটাকে বেঁধে রাখ। দুজন পাহারায় থাক—অন্যেরা আমার সাথে চল স্কুলে।
রিভলবার হাতে মানুষটা বলল, হ্যাঁ, দেরি হয়ে যাচ্ছে। স্যার অপেক্ষা করছেন।