মানুষ দুজন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে পায় বুলবুল পাখা ঝাঁপটিয়ে আকাশে উঠে যাচ্ছে। তারা টর্চলাইটের আলোতে দেখতে চেষ্টা করে কিন্তু ভালো করে কিছু দেখতে পেল না, দেখতে দেখতে বুলবুল টর্চলাইটের আলোর সীমানার বাইরে চলে গেল।
আনোয়ারা হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, দেখতে পায় মানুষ দুজনের চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে আরো মানুষ লাঠিসোটা নিয়ে হাজির হচ্ছে। লোকজনের চিৎকার চেঁচামেচি হইচই, দেখতে দেখতে সেখানে বিশাল একটা জটলা শুরু হয়ে গেল। তারা সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে থাকে। আনোয়ারা বুঝতে পারে তার শরীর থরথর করে কাঁপছে।
ভোর রাতে আনোয়ারা দেখল বুলবুল খুব সাবধানে বাসার পেছন দিয়ে এসে ঘরে ঢুকল। তার চোখে-মুখে আতঙ্ক। আনোয়ারা ছুটে গিয়ে বুলবুলকে জাপটে ধরে বলল, তুই কোন দিক দিয়ে এসেছিস?
পিছনের বড় গাছটার ওপর নেমে লুকিয়ে ছিলাম।
কেউ দেখে নাই তো?
না খালা।
তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতরে আয়।
বুলবুল আনোয়ারার হাত ধরে ঘরে ঢুকল। আনোয়ারা শুকনো গামছা দিয়ে শরীরটা মুছতে মুছতে বলল, কী সর্বনাশ হয়েছে দেখেছিস? তোকে দেখে ফেলেছে। এখন কী হবে?
মনে হয় চিনে নাই খালা, আমি তো মুখ ঢেকে রেখেছিলাম।
তুই কেমন করে জানিস চিনে নাই?
চিনলে এতক্ষণে সবাই বাড়িতে চলে আসত না?
আনোয়ার মাথা নাড়ল, বলল, সেটা ঠিক। কেউ বাড়িতে আসে নাই।
তারা চিনে নাই। খালি বলছিল জিনের বাচ্চা! জিনের বাচ্চা কেন বলছিল খালা?
তোর পাখা দেখে। মানুষের পিঠে কি পাখা থাকে?
খালা।
উঁ।
আমি কি আসলেই জিনের বাচ্চা?
ধুর বোকা, তুই কেন জিনের বাচ্চা হবি?
তাহলে আমার পাখা কেন আছে?
আমি এত কিছু বুঝি না, তুই ঘুমা। আনোয়ারা একটু ভেবে বলল, আর শোন।
কী খালা।
সকাল বেলা ঘর থেকে বের হবি না। যদি দেখি লোকজন আসছে আমি তাদের আটকে রাখব, তুই পিছন দরজা দিয়ে বের হয়ে পালিয়ে যাবি।
ঠিক আছে খালা।
আনোয়ারা হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, জহুর যখন আসবে, শুনে কী রাগ করবে!
জহুর শুনে রাগ করল না, শুনে সে খুব ভয় পেল। ঘটনাটার কথা অবশ্যি সে আনোয়ারার মুখে শোনেনি। ঘাটে নৌকা থেকে নেমে সে যখন মাত্র তীরে উঠেছে তখনই একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ জহুরকে বলল, জহুর শুনেছ ঘটনা?
কী ঘটনা।
সদর থেকে আক্কাস আর জালাল আসছিল। রাত্রি বেলা। তোমার। বাড়ির সামনে যে মাঠ সেই মাঠে জিন দেখেছে।
জিন?
হ্যাঁ। এই বড় বড় দাত, চোখের মাঝে আগুন। সাপের মতো লেজ।
জহুর হাসি গোপন করে বলল, তাই নাকি?
হ্যাঁ। সেই মাঝরাত্রে কী হইচই, লাঠিসোটা নিয়ে আমরা সবাই বের হয়েছিলাম।
জহুর বলল, জিনটাকে ধরেছ?
নাহ্ ধরা যায়নি।
কেন ধরা গেল না?
আকাশে উড়ে গেছে।
হঠাৎ করে জহুর ভেতরে ভেতরে চমকে উঠল, কিন্তু বাইরে সে সেটা প্রকাশ হতে দিল না। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, উড়ে গেছে?
হ্যাঁ।
কেমন করে উড়ে গেল?
আমি তো নিজের চোখে দেখি নাই। আক্কাস আর জালাল দেখেছে। পাখা বের করে উড়ে চলে গেছে।
জহুর নিঃশ্বাস বন্ধ করে জিজ্ঞেস করল, পাখা?
হ্যাঁ। পাখা আছে। বড় বড় পাখির মতোন পাখা।
জহুর কিছু বলল না, কিন্তু তার বুকের মাঝে হৃৎপিণ্ড ধ্বক ধ্বক করতে লাগল। মধ্যবয়স্ক মানুষটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার কী মনে হয় জান জহুর?
কী?
নবীগঞ্জের পীর সাহেবরে এনে এই চরে একটা খতম পড়ানো দরকার।
জহুর মাথা নাড়ল, বলল, হুঁ।
খানিকটা সামনে এসে দেখল একটা ছোট জটলা, জহুর দাঁড়িয়ে যায় এবং শুনতে পায় সেখানেও জিনের বাচ্চাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে এখানে জিনের বাচ্চার বর্ণনা এত ভয়ঙ্কর নয়, গায়ের রং ধবধবে সাদা, শরীরে একটা সুতাও নেই, মাথায় ছোট ছোট দুইটা শিং। জহুর আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার পর আরো একজনের সাথে দেখা হলো, সেও জহুরকে জিনের বাচ্চার গল্প শোনাল, তার ভাষ্য অনুযায়ী জিনের বাচ্চা চিকন গলায় একটা গান গাইছিল। আরবি ভাষার গান।
বাড়ি আসতে আসতে জহুর অনেকগুলো বর্ণনা শুনে এল, প্রত্যেকটা বর্ণনা ভিন্ন ভিন্ন, তবে সবার মাঝে একটা বিষয়ে মিল আছে। যে মূর্তিটি দেখা গেছে তার পাখির মতো বড় বড় দুটি পাখা আছে এবং সে পাখা দুটি ঝাঁপটিয়ে আকাশে উড়ে গেছে।
বাড়ি এসে জহুর সোজাসুজি আনোয়ারার সাথে দেখা করল। আনোয়ারা ফিসফিস করে বলল, খবর শুনেছ জহুর?
জহুর নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ। শুনেছি।
আনোয়ারা গলা নামিয়ে বলল, কপাল ভালো কেউ চিনতে পারে নাই। চিনতে পারলে যে কী বিপদ হতো!
জহুর এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, চিনতে না পারলে কী হবে আনোয়ারা বুবু। বিপদ যেটা হবার সেটা কিন্তু হয়েছে।
আনোয়ারা শুকনো মুখে বলল, কী বিপদ?
চারিদিকে খবর ছড়িয়ে গেছে যে এইখানে কোনো একজন আকাশে উড়ে। সেই খবর আস্তে আস্তে আরো দূরে যাবে। গ্রামের মানুষ ভাবছে এইটা জিনের বাচ্চা। কিন্তু যারা বুলবুলকে এত দিন ধরে খুঁজছে তারা ঠিকই বুঝবে এইটা জিনের বাচ্চা না। তারা তখন বুলবুলকে ধরে নিতে আসবে।
সর্বনাশ!
হ্যাঁ। সর্বনাশ।
এখন কী হবে?
জানি না। সাবধান থাকতে হবে। খুব সাবধান। এই চরে বাইরের মানুষকে দেখলেই কিন্তু সাবধান।
আনোয়ারা ভয়ার্ত মুখে দাওয়ায় বসে বলল, জহুর।
বল আনোয়ারা বুবু।
তুমি বুলবুলকে একটু বুঝিয়ে বল কী হলে কী করতে হবে, একটু সাবধান করে দিও।
দিব।
আহারে। সোনা বাচ্চাটা আমার। আনোয়ারা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এত বড় পৃথিবী, কিন্তু তার শান্তিতে থাকার কোনো জায়গা নাই।
২.৪ পরের কয়েক সপ্তাহ
পরের কয়েক সপ্তাহ জহুর খুব দুশ্চিন্তায় কাটাল, যদিও কেউ তার মুখ দেখে সেটা বুঝতে পারল না, সে শান্তভাবে দৈনন্দিন কাজ করে যেতে লাগল। নৌকার মাঝি হিসেবে দূরে যাওয়ার একটা সুযোগ পেয়েছিল, জরুরি কাজ বলে খুবই লোভনীয় পারিশ্রমিক দেয়ার কথা কিন্তু জহুর চর ছেড়ে যেতে রাজি হলো না, সে বাড়ির আশপাশে গৃহস্থালি কাজ করে সময় কাটিয়ে দিতে লাগল। জিনের বাচ্চাকে দেখার সেই ঘটনার কথাও ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যায়, এক সময় মানুষ সেটার কথা ভুলে যায় এবং পুরো ব্যাপারটাকে অনেকেই আক্কাস এবং জালালের একটা ঠাট্টা হিসেবে ধরে নেয়। মাসখানেক কেটে যাওয়ার পর জহুরও খুব ধীরে ধীরে খানিকটা দুশ্চিন্তামুক্ত হতে শুরু করে।