বুলবুল বলল, একটু বাইরে যাব খালা।
কেন? পেশাব করবি?
না খালা।
তাহলে?
ঘরের ভেতরে থাকতে পারছি না। একটু বাইরে গিয়ে পাখা ঝাপটাতে হবে খালা।
আনোয়ারা কী বলবে বুঝতে পারল না। তার পাখা নেই, একজন মানুষের পাখা থাকলে তার কেমন লাগে, তাকে কী করতে হয়, সেটা সে জানে না। সেটা শুধু যে সে জানে না তা নয়, মনে হয় পৃথিবীর কেউই জানে না। তাই বুলবুল যে মাঝরাতে ঘর থেকে বের হয়ে বাইরে গিয়ে পাখা ঝাঁপটাতে চাইছে সেটার পেছনে কোনো যুক্তি আছে কি নেই সেটা আনোয়ারা বুঝতে পারে না।
আনোয়ারা বলল, বাবা বুলবুল, এত রাতে বাইরে বের হবি পাখা ঝাপটানোর জন্যে? যদি কেউ দেখে ফেলে?
দেখবে না খালা— বুলবুল অনুনয় করে বলল, সবাই এখন ঘুমাচ্ছে। তা ছাড়া বাইরে কুচকুচে অন্ধকার, কেউ দেখতে পাবে না।
আনোয়ারা মাথা নাড়ল, বলল, উহু! জহুর একশবার করে না করে। গেছে সে না আসা পর্যন্ত তোকে যেন উড়তে না দিই।
আমি উড়ব না খালা! আমি শুধু পাখা ঝাপটাব!
একই কথা। খালা আমাকে একটু বের হতে দাও। এই একটুখানি—
আনোয়ারা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে। কিন্তু তোকে আমি একা বের হতে দিব না। আমি আগে যাব, দেখব কেউ আছে কি না।
বুলবুল খুব খুশি হয়ে রাজি হলো, বলল, ঠিক আছে।
তখন সেই নিশুতি রাতে বুলবুলের হাত ধরে আনোয়ারা বের হলো। উঠোনে উঁকি দিয়ে দেখল যখন কেউ নেই তখন বুলবুল দুই পাখা ছড়িয়ে দিয়ে সেগুলো ঝাঁপটাতে থাকে। আনোয়ারা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে—সে কি কখনো ভেবেছিল একজন মানুষের পাখির মতো পাখা হবে? সেই মানুষটিকে সে বুকে ধরে বড় করবে?
বার দুয়েক ডানা ঝাঁপটিয়ে বুলবুল থেমে যায়—আনোয়ারা বলল, হয়েছে? এখন ভেতরে আয়।
বুলবুল বলল, হয়নি খালা। উঠোনটা কত ছোট দেখেছ? পাখাটা ভালো করে ছাড়াতেই পারছি না। সামনের মাঠটাতে একটু যাই?
আনোয়ারা আঁতকে উঠে বলল, না, বুলবুল না! সর্বনাশ!
একটুখানি! এই একটুখানি?
সর্বনাশ! কেউ দেখে ফেলবে।
কেউ দেখবে না খালা! দেখছ না কেউ নাই? সবাই ঘুমিয়ে আছে।
হঠাৎ করে কেউ চলে আসবে!
আসবে না খালা! আমি একবার যাব আর আসব।
আনোয়ারা কিছু বলার আগেই বুলবুল দুই পা ছড়িয়ে উঠোন থেকে বের হয়ে সামনের মাঠে ছুটে যেতে থাকে। আনোয়ারা কাঠ হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে বুলবুলের ফিরে আসার জন্যে।
অন্ধকারের মাঝে বুলবুলকে আবছা আবছাভাবে দেখা যায়। সে খোলা মাঠের উপর দিয়ে ডানা মেলে ছুটে যাচ্ছে—হঠাৎ হঠাৎ করে সে ডানা ঝাঁপটিয়ে একটু উপরে উঠে যাচ্ছে, আবার নেমে আসছে। দেখতে দেখতে বুলবুল মাঠের অন্যপাশে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। আনোয়ারা নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে এবং একসময় দেখতে পায় বুলবুল ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে আবার ফিরে আসছে। আনোয়ারার বুকের ভেতর পানি ফিরে আসে। বুলবুল কাছে আসতেই সে ফিসফিস করে ডেকে বলল, আয় এখন! ভেতরে আয়। এক্ষুনি আয়।
আর একবার ছোট খালা। মাত্র একবার!
না।
মাত্র একবার। এই শেষ খালা— বলে বুলবুল পাখা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে মাঠের অন্যপাশে ছুটে যেতে থাকে।
আনোয়ারা আবার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্ধকারে সে আবছা আবছা দেখতে পায় বুলবুল পাখা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে দূরে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।
ঠিক এই সময় আনোয়ারা টর্চলাইটের আলোর একটা ঝলকানি এবং দুজন মানুষের গলার আওয়াজ শুনতে পেল, সাথে সাথে আতঙ্কে তার হৃৎস্পন্দন থেমে গেল।
আনোয়ারা তার উঠানের আড়ালে সরে যায়—এখন বুলবুলকে দেখতে না পেলেই হলো। সে বিড়বিড় করে বলল, হে খোদা! হে দয়াময়—বুলবুলকে যেন এই মানুষগুলো দেখতে না পায়। বুলবুল ফিরে। আসতে আসতে মানুষগুলো যেন চলে যায়। হে খোদা! হে পরওয়ারদিগার। হে রাহমানুর রাহিম।
কিন্তু খোদা আনোয়ারার দোয়া শুনল না, কারণ হঠাৎ করে সে মানুষ দুজনের ভয়ার্ত গলার স্বর শুনতে পায়। একজন চমকে উঠে ভয় পাওয়া গলায় বলল, এইটা কী?
দ্বিতীয়জন চাপা গলায় বলল, হায় খোদা। সর্বনাশ।
আনোয়ারা দেখল বুলবুল নিশ্চিন্ত মনে ছুটে আসছে। সে জানেও না সামনে সুন্ধকারে দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে—তাদের হাতে একটা টর্চলাইট। মানুষগুলো ভীত এবং আতঙ্কিত। এই পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণী হচ্ছে ভীত এবং আতঙ্কিত মানুষ—তারা বুঝে হোক না বুঝে হোক ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে। মানুষগুলো কী করবে আনোয়ারা জানে না। সে এখন চিন্তাও করতে পারছে না।
আনোয়ারা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে এবং দেখতে পায় বুলবুল। ছুটতে ছুটতে কাছাকাছি এসে হঠাৎ করে মানুষ দুজনকে দেখতে পায়। সাথে সাথে সে দাঁড়িয়ে গেল—অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না, মানুষগুলো বোঝার চেষ্টা করছে। ঠিক তখন মানুষগুলোর একজন টর্চলাইটটা জ্বালিয়ে দিল, তীব্র আলোতে বুলবুলের চোখ ধাধিয়ে যায়, সাথে সাথে সে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলল! মানুষগুলো হতবাক হয়ে দেখল একজন শিশু পাখা মেলে দাঁড়িয়ে আছে।
ইয়া মাবুদ! জিনের বাচ্চা! বলে একজন মানুষ চিৎকার করে ওঠে।
ধর! ধর জিনের বাচ্চাকে— বলে হঠাৎ মানুষগুলো বুলবুলকে ধরার জন্যে ছুটে যেতে থাকে।
বুলবুল হঠাৎ করে যেন বিপদটা টের পেল, সাথে সাথে ঘুরে সে উল্টোদিকে ছুটতে শুরু করে। দুই পাখা সে দুই পাশে মেলে দেয়। বিশাল ডানা ছড়িয়ে সে ছুটতে থাকে, মানুষগুলো ঠিক যখন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল তখন সে পাখা ঝাঁপটিয়ে উপরে উঠে গেল।