আনোয়ারা বলল, আমার সাথে?
হ্যাঁ। বুলবুল গত রাত্রে আকাশে উড়েছে। এইটা ছিল তার প্রথম উড়া। সে আরো উড়বে। একশবার উড়বে, হাজারবার উড়বে। সে যত সময় মার্টিতে থাকে তার চাইতে বেশি সময় সে আকাশে থাকবে। তার মানে কী জান?
কী?
আগে হোক, পরে হোক তাকে কেউ না কেউ দেখবে। তখন কী হবে?
হ্যাঁ। কী হবে?
তখন তাকে ধরার চেষ্টা করবে। যদি ধরতে পারে তাহলে নিয়ে যাবে। কাটাকুটি করবে, তা না হলে কোথাও বেচে দেবে। খাঁচার মাঝে ভরে রাখবে, মানুষ টিকেট কিনে দেখবে।
আনোয়ারা শুকনো মুখে মাথা নাড়ল, বলল, সর্বনাশ!
হ্যাঁ আনোয়ারা বুবু, ব্যাপারটা চিন্তা করে আমি কাল রাতে ঘুমাতে পারি নাই।
তাহলে কী করবে?
আমি জানি না। খালি চেষ্টা করতে হবে ব্যাপারটা যেন কারো চোখে পড়ে। কেউ যেন জানতে না পারে।
বুলবুল যখন ঘুম থেকে উঠেছে তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। সে আরো ঘুমাত কিন্তু তার ঘুম ভেঙে গেল প্রচণ্ড ব্যথায়। দুই পাখা, পিঠ আর ঘাড়ে অসব ব্যথা। জহুর তাকে তার কোলে উপুড় করে শুইয়ে রসুনে ভেজানো গরম সরিষার তেল দিয়ে সারা শরীরে ডলে দিতে লাগল।
শরীরের ব্যথা নিয়ে সারাটি দিন বুলবুল আহা উঁহু করলেও সন্ধ্যেবেলা সে জহুরের হাত ধরে লাজুক মুখে বলল, বাবা!
কী?
আমার আবার আকাশে উড়ার ইচ্ছে করছে!
জহুর চোখ কপালে তুলে বলল, আকাশে উড়ার ইচ্ছে করছে?
হ্যাঁ বাবা।
তোর না সারা শরীরে ব্যথা!
বুলবুল তার পাখাগুলো একটু ছড়িয়ে আবার গুটিয়ে নিয়ে বলল, ব্যথা কমে গেছে বাবা!
জহুর কিছুক্ষণ বুলবুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে!
রাত যখন গভীর হয়ে এলো জহুর আবার বুলবুলকে নৌকা করে নিয়ে গেল জনমানবহীন সেই চরে। বুলবুল আবার পাখা ঝাঁপটিয়ে আকাশে উড়ে গেল—আগের দিন থেকেও অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসে!
এভাবেই শুরু হলো। প্রতিরাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে গেছে তখন জহুর বুলবুলকে নৌকা করে নিয়ে গেছে চরে। পুবের আকাশ ফর্সা না হওয়া পর্যন্ত বুলবুল আকাশে উড়েছে!
দুই সপ্তাহ পর জহুরের আবার ডাক পড়ল গম বোঝাই বড় একটা নৌকার মাঝি হয়ে সুন্দরবনের গহিনে যাবার জন্যে। জায়গাটা বিপজ্জনক, সবাই যেতে চায় না, তাই কেউ যখন যায় তাকে ভালো মজুরি দেয়া হয়। দুই সপ্তাহ পরিশ্রম করলে চার সপ্তাহ শুয়ে-বসে কাটিয়ে দেয়া যায়।
জহুর যখন বিদায় নিয়ে রওনা দিয়েছে তখন বুলবুল তার পেছনে পেছনে এসেছে। নদীর ঘাটে বুলবুল জহুরের হাত ধরে বলল, বাবা।
বল।
এখন আমাকে চরে কে নিয়ে যাবে?
তোকে নেয়ার এখন কেউ নেই। আমি না আসা পর্যন্ত তোর আকাশে উড়াউড়ি বন্ধ।
কিন্তু বাবা—
কোনো কিন্তু নেই।
আমার যদি খুব উড়ার ইচ্ছে করে?
ইচ্ছে করলেই হবে না। আমি না আসা পর্যন্ত উড়তে পারবি না।
বুলবুল অনিচ্ছার ভঙ্গি করে বলল, ঠিক আছে।
২.৩ জহুরদের নৌকাটা
জহুরদের নৌকাটা চারদিন পর সুন্দরবনের ভেতরে পৌঁছাল। জোয়ারের সময় এটাকে নোঙর করে রেখে শুধু ভাটির সময় দক্ষিণে বেয়ে নেয়া হতো। সুন্দরবনের গহিনে নিবিড় অরণ্য, রাত্রি বেলা ঘুমানোর সময় রীতিমতো ভয় করে। বন বিভাগ থেকে একজন আনসার দেয়া হয়েছে, সে একটা পুরানো বন্দুক নিয়ে পাহারা দেয়। এই বন্দুকটি দিয়ে শেষবার কবে গুলি ছোড়া হয়েছে সেটা কেউ জানে না, বিপদের সময় এটা থেকে গুলি বের হবে কি না সেটা নিয়েও সবার মাঝেই সন্দেহ আছে।
গমের বোঝা নামিয়ে জহুর আর মাঝি মাল্লারা নৌকা নিয়ে আরো গভীরে ঢুকে যায়, বন বিভাগের কিছু গাছের গুঁড়ি তাদের নিয়ে যেতে হবে। জহুর আগে কখনো এত গভীরে আসেনি, এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে সে এই নির্জন অরণ্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। নদীর তীরে হরিণের দল পানি খেতে আসে, সতর্ক দৃষ্টিতে এদিক সেদিক দেখে চুকচুক করে একটু পানি খেয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ছন্দ তুলে লাফিয়ে লাফিয়ে গহিন বনে অদৃশ্য হয়ে যায়। গাছের ডালে বানর-শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বানর-মায়েরা বসে থাকে। গাছের পাতা ছিঁড়ে ছিড়ে খেতে খেতে অকারণেই তারা তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে। নদীর তীরে কাদায় কুমির মুখ হাঁ করে রোদ পোহায়। দেখে মনে হয় বুঝি ঢিলেঢালা প্রাণী কিন্তু মানুষের সাড়া পেলেই বিদ্যুৎগতিতে নদীর পানিতে অদৃশ্য হয়ে যায়। গাছে হাজার হাজার পাখি কিচিরমিচির করে ডাকছে। জহুর সবকিছু এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে দেখে।
নৌকায় যখন গাছের গুঁড়ি তোলা হচ্ছে তখন জহুর আনসার সদস্যটির সাথে বনের ভেতর হুঁটিতে বের হলো। মানুষটি কথা বলতে ভালোবাসে, জহুর কথা বলে কম কিন্তু ধৈর্য ধরে শুনতে পারে, তাই দুজনের জুটিটি হলো চমৎকার। আনসারের সদস্যটা বন্দুকটা হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, এই যে আমরা হাঁটছি, আপনি ভাবছেন আমাদের কেউ দেখছে না। আসলে এইটা সত্যি না। আমাদের কিন্তু দেখছে।
কে দেখছে?
কে আবার? মামা।
জহুর এত দিনে জেনে গেছে সুন্দরবনে বাঘকে সম্মান করে মামা বলা হয়-বাঘকে নাম ধরে ডাকা নিয়ে একটা কুসংস্কার আছে।
সে মাথা নেড়ে বলল, অ।
সব সময় আমাদের চোখে চোখে রাখে। নিঃশব্দে আমাদের পেছনে পেছনে হাঁটে।
এখনো হাঁটছে?
নিশ্চয়ই হাঁটছে। যাওয়ার সময় দেখবেন পায়ের ছাপ। আমাদের পেছনে পেছনে হেঁটে যাচ্ছে।
জহুর জিজ্ঞেস করল, আমাদের খেয়ে ফেলবে না তো?
নাহ্! বাঘ মানুষকে খায় না। জঙ্গলে এত মজার মজার খাবার আছে মানুষকে খাবে কেন? মানুষের শরীরে গোশত আর কতটুকু, সবই তো হাড়িভ।