জহুর সবিস্ময়ে বুলবুলের দিকে তাকিয়ে থাকে, অতিকায় একটা পাখির মতো বুলবুল বাতাসে ভেসে উঠছে। জহুর বুলবুলের পেছনে পেছনে ছুটতে ছুটতে বলে, বেশি উপরে উঠিস না বাবা! বেশি উপরে উঠিস না!
জহুরের কথার জন্যেই হোক কিংবা অভ্যাস নেই বলেই হয়তো বুলবুল আবার নিচে নেমে আসতে থাকে।
মাটির কাছাকাছি এসে বুলবুল তাল সামলাতে পারল না, হুঁমড়ি খেয়ে দুই পাখা ছড়িয়ে বালুর মাঝে পড়ে গেল। জহুর ছুটতে ছুটতে বুলবুলের কাছে গিয়ে তাকে ধরে ওঠানোর চেষ্টা করে বলল, বাবা, ঠিক আছিস তুই?
বুলবুল মাথা নাড়ল, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, হ্যাঁ বাবা আমি ঠিক আছি।
কী সুন্দর তুই উড়েছিস দেখলি?
হ্যাঁ বাবা। আমি আসলেই উড়তে পারি। দেখেছ?
হ্যাঁ দেখেছি। বুলবুল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি আবার একটু উড়ি বাবা?
জোছনার আলোতে বুলবুলের মুখের দিকে তাকিয়ে জহুর বলল, উড়বি? উড়।
বুলবুল তখন আবার তার দুটি পাখা দুই পাশে ছড়িয়ে দেয়, তারপর দুটি হাত বুকের কাছে নিয়ে আসে, মাথাটা একটু সামনে ঝুঁকিয়ে সে সামনের দিকে ছুটতে থাকে। ছুটতে ছুটতে তার বিশাল পাখা দুটি ধীরে ধীরে ঝাঁপটাতে থাকে, দেখতে দেখতে বুলবুল উপরে উঠে যেতে থাকে। প্রথমবার বেশি উপরে ওঠেনি কিন্তু এবারে সে উপরে উঠতেই থাকে, জোছনার আলোতে বুলবুল তার পাখা দুটি বিস্তৃত করে অতিকায় একটা পাখির মতো। আকাশে উঠে যেতে থাকে। জহুর কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে, ঠিক কী কারণ জানা নেই সে বুকের ভেতর একটা গভীর ব্যথা অনুভব করে।
বুলবুল অনেক উপরে উঠে একটু ঘুরে যায়, তারপর ডানা দুটি মেলে আকাশে ভাসতে থাকে। মনে হয় পৃথিবীর সাথে তার বুঝি আর কোনো যোগাযোগ নেই, মাটি থেকে অনেক উপরে আকাশের কাছাকাছি মেঘের জগতে বুঝি সে তার নতুন আবাসস্থল খুঁজে পেয়েছে। জহুরের মনে হয় বুকে ধরে বড় করা তার এই খুঁজে পাওয়া সন্তানটি বুঝি আর কোনো দিন মাটির পৃথিবীতে ফিরে আসবে না।
আকাশ থেকে বুলবুল যখন মাটিতে নেমে এল তখন চাঁদটা পশ্চিমে অনেকখানি হেলে পড়েছে। বুলবুল তার পাখা দুটো ভঁজ করে গুটিয়ে নিয়ে জহুরের দিকে এগিয়ে এল। জহুর তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে, বুলবুলের সারা শরীর কুয়াশায় ভিজে গেছে। চাদর দিয়ে মাথাটা মুছিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোর কষ্ট হয়েছে বাবা?
না বাবা, বেশি কষ্ট হয় নাই। উপরে ওঠার সময় একটু পরিশ্রম হয়, কিন্তু ভেসে থাকার সময় একটুও কষ্ট হয় না?
তোর পাখাগুলো ব্যথা করছে?
হ্যাঁ বাবা, পাখাগুলো একটু ব্যথা করছে।
কাল ভোরে আরো অনেক ব্যথা করবে দেখিস।
কেন বাবা?
কখনো কোনো দিন ব্যবহার করিসনি, হঠাৎ একবারে এতক্ষণ উড়ে বেড়ালে ব্যথা করবে না?
করলে করবে।
উড়তে কেমন লাগে বাবা?
খুব অদ্ভুত। তুমি জানো উপরে উঠে গেলে মনে হয় সবকিছু সমান হয়ে গেছে!
জহুর নিঃশব্দে বুলবুলের দিকে তাকিয়ে রইল, কিছু না বুঝেই এই ছোট শিশুটি কত বড় একটা কথা বলে ফেলেছে! জহুর বুলবুলের হাত ধরে বলল, আয় বাড়ি যাই।
চল বাবা।
নৌকায় উঠে লগি দিয়ে নৌকাটাকে নদীর মাঝে ঠেলে দিয়ে জহুর কলল, বুলবুল।
হ্যাঁ বাবা।
তোকে একটা জিনিস বলি।
বল।
যদি তোর কখনো লুকিয়ে থাকতে হয় তাহলে তুই এসে এই চরের মাঝে লুকিয়ে থাকবি। ঠিক আছে?
বুলবুল অবাক হয়ে বলল, লুকিয়ে থাকতে হবে? লুকিয়ে থাকতে হবে কেন?
আমি বলছি না তোর লুকিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু যদি কখনো দরকার হয় তাহলে এই চরে এসে লুকিয়ে থাকবি। আমি পরে এসে তোকে খুঁজে বের করব। ঠিক আছে?
বুলবুল মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে। তারপর সে তার বাবার কোলে মাথা রেখে নৌকার গলুইয়ে শুয়ে পড়ে। চাদটাকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ বুঝি এক পাশে খানিকটা ভেঙে দিয়েছে! কেমন করে চাঁদটা এভাবে ভেঙে যায় সেই কথাটি তার মাথার মাঝে ঘুরপাক খেতে থাকে, বাবাকে জিজ্ঞেস করলে হয়। কিন্তু হঠাৎ করে তার সারা শরীর ক্লান্তিতে অবশ হয়ে যায়। তারা চোখ ভেঙে ঘুম নেমে আসে, কিছু বোঝার আগেই বুলবুল গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল।
ভোরবেলা আনোয়ারা এসে দেখে জহুর উঠানের মাঝখানে জলচৌকিতে চুপচাপ বসে আছে। আনোয়ারাকে দেখে বলল, আস আনোয়ারা বুবু। বস।
আনোয়ারা বলল, বুলবুল আজকে স্কুলে গেল না?
না। জহুর মাথা নাড়ে, ঘুমাচ্ছে।
এখনো ঘুমাচ্ছে?
হ্যাঁ। কাল রাতে ঘুমাতে অনেক দেরি হয়েছে তো।
কেন? দেরি হয়েছে কেন?
নদীর মাঝখানে যে নতুন চরটা উঠেছে সেখানে গিয়েছিলাম।
আনোয়ারা চোখ কপালে তুলে বলল, এত রাত্রে? চরে?
জহুর মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।
কেন?
বুলবুল আকাশে উড়তে চাইছিল তাই নিয়ে গিয়েছিলাম।
উড়তে? আকাশে উড়তে?
হ্যাঁ। উড়েছে?
হ্যাঁ। কী সুন্দর আকাশে উড়ে গেল। বুবু তুমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবে না।
সত্যি?
হ্যাঁ বুবু। সত্যি।
কী আশ্চর্য!
জহুর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? বুলবুলের তো জন্ম হয়েছে আকাশে উড়ার জন্যে! সে আকাশে উড়বে না?
তাই বলে একজন মানুষ পাখির মতো আকাশে উড়বে?
বুলবুল কি পুরোপুরি মানুষ?
মানুষ না?
না। পুরোপুরি মানুষ না। মানুষের পাখা থাকে না। মানুষের শরীর এত হালকা হয় না! মানুষ আকাশে উড়ে না। বুলবুল হচ্ছে এক সাথে মানুষ আর পাখি। আমি চেষ্টা করেছিলাম সে যখন ছোট ছিল তার পাখা দুটো কেটে ফেলতে পারি নাই। এখন তো আর পারা যাবে না।
আনোয়ারা চিন্তিত মুখে মাথা নাড়ল। জহুর বলল, আনোয়ারা বুবু, আমি তোমার সাথে একটু পরামর্শ করি।