হ্যাঁ খালা, মনে আছে। ঝগড়া করবি না, মারামারি করবি না, পানিতে নামবি না, শার্ট খুলবি না!
আনোয়ারা বলল, তোর যে পাখা আছে সেইটা কেউ জানে না। জানলে বিপদ হবে।
বুলবুলকে হঠাৎ একটু বিভ্রান্ত দেখায়। সেই ছোটবেলা থেকে বুলবুল জানে সে অন্য রকম। তার পাখা আছে—কিন্তু সেটা কাউকে বলা যাবে না। সেটা লুকিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু কেন সেটা কাউকে বলা যাবে না, কেন সেটা লুকিয়ে রাখতে হবে সে জানে না। কখনো কাউকে জিজ্ঞেস করেনি। আজকে জিজ্ঞেস করল, কেন খালা? আমার পিঠে পাখা আছে, সেটা কেন কাউকে বলা যাবে না?
আনোয়ারা কী উত্তর দেবে বুঝতে পারে না। ইতস্তত করে বলল, তুই কি আর কোনো মানুষের পিঠে পাখা দেখেছিস?
না। দেখি নাই।
তাহলে? যারাই দেখবে তোর পাখা আছে তারা অবাক হবে তোকে নিয়ে টানাটানি করবে।
কেন টানাটানি করবে।
এইটা মানুষের নিয়ম। যেটা অন্য রকম সেইটা নিয়ে মানুষ টানাটানি করে।
বুলবুল বলল, ও। ব্যাপারটা সে পরিষ্কার বুঝতে পারল না কিন্তু সেটা নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চাইল না। বলল, খালা। আমার খুব রাগ লাগে যখন সবাই আমাকে কুঁজা ডাকে।
ডাকুক। আনোয়ারা বুলবুলির থুতনি ধরে আদর করে বলল, আসলে কি তুই কুঁজা?
না।
তাহলে ডাকলে ডাকুক। তুই তাদের সাথে তর্ক করবি না।
বুলবুল কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল। আনোয়ারা আবার মনে করিয়ে দিল, মনে থাকবে তো?
থাকবে।
বুলবুলের অনেক কিছুই মনে রাখতে হয়। সে অন্য রকম সেটা সে কখনো ভুলতে পারে না। যতই দিন যাচ্ছে তার পাখাগুলো ততই বড় হয়ে উঠছে, কাপড় দিয়ে যখন পেঁচিয়ে রাখা হয় তখন তার কষ্ট হয়। কিন্তু সে অন্য রকম, তাই কষ্ট হলেও তাকে সেই কষ্ট সহ্য করতে হয়। মাঝে মাঝে বুলবুল ভাবে, সবাই এক রকম, সে অন্য রকম কেন? এই প্রশ্নটাও সে কাউকে করতে পারে না।
সকাল বেলা নাশতা করে বুলবুল তার বই-খাতা আর স্লেট নিয়ে স্কুলে রওনা হলো। এই চরে মানুষজন খুব বেশি না, কাজেই এখানে কোনো স্কুল নাই। কিছুদিন আগে শহর থেকে কিছু লোকজন এসে সবাইকে ডেকে লেখাপড়া নিয়ে অনেক ভালো ভালো কথা বলে একটা স্কুল তৈরি করে দিয়ে গেছে। সেটা অবশ্যি সত্যিকারের স্কুল না, এই স্কুলে চেয়ার টেবিল বেঞ্চ নাই, একটা মাটির ঘরে হোগলা পেতে সব বাচ্চারা বসে। মালবিকা নামে নাদুসনুদুস একটা মহিলা তাদের পড়তে শেখায়, যোগ-বিয়োগ করতে শেখায়। বাচ্চারা এই স্কুলে যেতে চায় না কিন্তু বুলবুল খুব আগ্রহ নিয়ে যায়। লেখাপড়া জিনিসটা কী সে খুব ভালো করে জানে না কিন্তু সেটা শিখতে তার খুব আগ্রহ।
বুলবুল তার বই-খাতা আর স্লেট নিয়ে স্কুলে রওনা হলো। মাঠের ভেতর দিয়ে হেঁটে গেলে অনেক তাড়াতাড়ি যাওয়া যায় কিন্তু বুলবুল সব সময় নদীর তীর দিয়ে হেঁটে যায়। একা একা হাঁটার সময় সে নিজের মনে কথা বলে, ভারী ভালো লাগে তখন।
নদীর ধারে কমবয়সী কিছু ছেলেমেয়ে নদীর ঘোলা পানিতে ঝাপাঝাপি করছিল, বুলবুলকে দেখে তারা চেঁচামেচি শুরু করল, দু-একজন গলা ফাটিয়ে ডাকল, বুলবুল! এই বুলবুল!
বুলবুল নদীর তীরে দাঁড়িয়ে বলল, কী?
আয়, পানিতে আয়।
বুলবুল মাথা নাড়ল, বলল, নাহ্।
কেন না?
স্কুলে যাই!
তুই স্কুলে গিয়ে কী করবি? জজ ব্যারিস্টার হবি?
বুলবুল কোনো কথা বলল না। পানিতে দাপাদাপি করতে করতে একজন বলল, কুঁজা জজ। কুঁজা ব্যারিস্টার। কুঁজা বুলবুল!
তখন সবগুলো বাচ্চা হি হি করে হাসতে হাসতে পানিতে দাপাদাপি করতে থাকে।
বুলবুল কিছুক্ষণ নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর আবার হাঁটতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পায় বাচ্চাগুলো তাকে নিয়ে টিটকারি করছে। কুঁজা কুঁজা বলে চিল্কার করছে। বুলবুল বিড়বিড় করে নিজেকে বলল, আমি কুঁজা না! আমি একদিন আমার এই পাখা দিয়ে আকাশে উড়ে যাব—কেউ তখন আমাকে খুঁজে পাবে না।
স্কুলে গিয়ে দেখে তখনো সবাই আসেনি। স্কুলের সামনে খোলা জায়গাটাতে সবাই হা-ড়ু-ড়ু খেলছে। একজন বুলবুলকে ডাকল, এই কুঁজা বুলবুল! আয় হা-ড়ু-ড়ু খেলবি।
বুলবুল রাজি হলো না। তার শরীর পাখির পালকের মতো হালকা, সে কাউকে ধরে রাখতে পারে না। কাউকে জাপটে ধরলে তাকেসহ টেনে নিয়ে যায়। তা ছাড়া খালা তাকে বলেছে সে যেন কখনো কারো সাথে ধাক্কাধাক্কি করে। তার যে রকম পাখা আছে সেটা কাউকে জানতে দেয়া যাবে না, ঠিক সে রকম তার শরীর যে পাখির পালকের মতো হালকা সেইটাও কাউকে জানতে দেয়া যাবে না।
বুলবুল স্কুলের সামনে পা ছড়িয়ে বসে খেলা দেখতে লাগল, তখন লিপি তার ছোট ভাইটাকে কোলে নিয়ে হাজির হলো। বুলবুলের মতো লিপিরও খুব লেখাপড়া করার ইচ্ছা। তার ছোট ভাইকে দেখেশুনে রাখতে হয়, তারপরেও সে স্কুলে চলে আসে। লিপি বুলবুলের পাশে পা ছড়িয়ে বসে ছোট ভাইটাকে ছেড়ে দিল। ছোট ভাইটা ধুলোর মাঝে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে ছোট ছোট পিঁপড়া খুঁজে বের করতে থাকে।
লিপি জিজ্ঞেস করল, বুলবুল, তুই অঙ্কগুলো করেছিস?
বুলবুল মাথা নাড়ল। স্কুলের সবাই তাকে কখনো না কখনো কুঁজা বুলবুল ডেকেছে—লিপি ছাড়া। লিপি তাকে কখনো কুঁজা বুলবুল ডাকেনি। সে জন্যে বুলবুল লিপিকে একটু পছন্দই করে।
লিপি বলল, আমাকে অঙ্কগুলো দেখাবি?
বুলবুল তার খাতা বের করে লিপিকে দেখাল। লিপি সেগুলো দেখে দেখে নিজের অঙ্কগুলো মিলিয়ে নেয়।
কিছুক্ষণের মাঝেই তাদের স্কুলের মালবিকা আপা এসে ঘরের তালা খুলে দিল। বুলবুল আর লিপি ভেতরে ঢুকে স্কুলঘরের জানালাটা খুলে দেয়। হোগলাপাতার মাদুরটা বিছিয়ে তাকের ওপর রাখা বইগুলো নামিয়ে আনতে খাকে। ততক্ষণে মাঠে খেলতে থাকা ছেলেগুলোও ক্লাসের ভেতরে এসে যার যার জায়গায় বসে গেছে। রোদে ছোটাছুটি করার কারণে একেকজন দরদর করে ঘামছে!