জহুর কোনো উত্তর দিল না। আনোয়ারা বিড়বিড় করে বলল, এখন একটা বিয়ে করে সংসারী হও। ছেলেমেয়ে থাকলে তারা মৃত্যুর পরে দোয়া করে। গোর আজাব মাফ হয়।
জহুর নিচু গলায় হাসার মতো একটা শব্দ করে বলল, আনোয়ারা বুবু তোমার শরীরটা কেমন?
আনোয়ারা একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করে বলল, আমার আবার শরীর। এক পা কবরে এক পা মাটিতে। আজরাইল সবার দিকে নজর দেয়, আমার দিকে নজর দেয় না।
জহুর মাথা নাড়ল, বলল, না আনোয়ারা বুবু। আজরাইল এখন তোমার দিকে নজর দিলে হবে না। তোমার আরো কয় বৎসর বাঁচা লাগবে।
কেন? আমার বাঁচা লাগবে কেন?
জহুর উঠে দাঁড়াল, ঘরের কোনায় মাচার ওপর শুইয়ে রাখা শিশুটাকে সাবধানে তুলে এনে আনোয়ারার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এই বাচ্চাটাকে তোমার মানুষ করে দিতে হবে।
আনোয়ারা বিস্ফারিত চোখে জহুরের দিকে তাকিয়ে থাকে, বলে, এইটা কার বাচ্চা?
সেইটা অনেক লম্বা ইতিহাস আনোয়ারা বুবু।
এত ছোট বাচ্চা তুমি কোথায় পেয়েছ? বাবা কী করে? মা কী করে?
বাবা নাই, মা নাই। বাচ্চার মাকে আমি নিজের হাতে কবর দিয়েছি।
আনোয়ার বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল, এই বাচ্চা দেখি পরীর মতোন সুন্দর। ছেলে না মেয়ে?
ছেলে।
তুমি পুরুষ মানুষ এত ছোট বাচ্চা নিয়ে আসছ কেন? এতিমখানায় রেখে আসলে না কেন? কত বড়লোকের পরিরার বাচ্চা নেয়—
জহুর বলল, সেইটা অনেক বড় ইতিহাস। তুমি বাচ্চাটাকে কোলে নাও তাহলে বুঝতে পারবে।
তাহলে কী বুঝতে পারব?
আগে একবার কোলে নাও তো।
আনোয়ারা হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েই বিস্ময়ে চিৎকার করে ওঠে, ইয়া মাবুদ! বাচ্চার কোনো ওজন নাই!
জহুর মাথা নাড়ে, নাই আনোয়ারী বুবু। এর কোনো ওজন নাই।
কেন? ওজন নাই কেন? আনোয়ারা বিস্ময় এবং আতঙ্ক নিয়ে শিশুটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
তুমি বাচ্চাটার কাপড় খুলো, খুলে দেখো। পিঠের দিকে দেখে।
আনোয়ারা সাবধানে পেঁচানো কাপড়টা খুলে বাচ্চাটার পিঠের দিকে তাকিয়ে অতিঙ্কে চিৎকার করে ওঠে, ইয়া মাবুদ! এ তো জিনের বাচ্চা
জহুর হাসার চেষ্টা করল, বলল, না আনোয়ারা বুবু। এইটা জিনের বাচ্চা না—
আনোয়ারা বাচ্চাটাকে দুই হাতে ধরে আতঙ্কে কাঁপতে থাকে, জিনের বাচ্চা! ইয়া মাবুদ! জিনের বাচ্চা!
জুহুর হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটিকে নিজে কোলে নিয়ে বলল, না আনোয়ারা বুবু, এইটা জিনের বাচ্চা না। এইটা মানুষেরই বাচ্চা। আমার সামনে এই বাচ্চার জন্ম হয়েছে। বাচ্চার মাকে আমি নিজের হাতে কবর দিয়েছি।
আনোয়ারা তখনো থরথর করে কাঁপছে। জহুর হাসার চেষ্টা করে বলল, ভয়ের কিছু নাই বুবু। এইটা মানুষের বাচ্চা। বাচ্চাটার পাখা আছে সেইটাই হচ্ছে বিপদ। শহরের ডাক্তার এই মাসুম বাচ্চাটাকে নিয়ে মেরে ফেলতে চায়। কেটে কুটে দেখতে চায়। অনেক কষ্টে উদ্ধার করে এনেছি আনোয়ারা বুবু।
আনোয়ারা তখনো কোনো কথা বলল না, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। জহুর বলল, আনোয়ারা বুবু, জন্মের আগে থেকেই এই বাচ্চাটা বিপদে। যেই দেখে সেই তারে কেটে কুটে ফেলতে চায়। এর মা আমার হাত ধরে বলেছে একে বাঁচিয়ে রাখতে। সেই জন্যে চেষ্টা করছি!
আনোয়ারা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এইটা আসলেই মানুষের বাচ্চা?
হ্যাঁ। শহরের মানুষজনের হাত থেকে অনেক কষ্ট করে বাঁচিয়ে এনেছি। এই চরে মানুষজন কম, এইখানে একে বড় করতে হবে। আনোয়ার বুবু তুমি বাচ্চাটাকে একটু বড় করে দাও।
আনোয়ারা আবার ভয়ে ভয়ে বাচ্চাটার দিকে তাকালো। বাচ্চাটা তখন হঠাৎ ফিক করে হেসে দেয়, দাঁতহীন মাঢ়ির সেই হাসি দেখে খুব ধীরে ধীরে আনোয়ারার মুখেও হাসি ফুটে ওঠে। ফিসফিস করে বলল, বাচ্চাটার হাসি কত সুন্দর।
জহুর বলল, শুধু হাসি না আনোয়ারা বুবু, এই বাচ্চার সবকিছু সুন্দর। শুধু একটা জিনিস সুন্দর না। সেটা হচ্ছে কপাল।
আনোয়ারা আবার হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটিকে কোলে নেয়, নিজের গালের সাথে তার গাল স্পর্শ করে বলল, এই বাচ্চাটার কোনো নাম আছে?
জহুর নাথা নাড়ল, বলল, আমি তাকে বুলবুলি ডাকি। বুলবুলি পাখির মতোন শরীর সেই জন্যে নাম বুলবুল!
বুলবুল?
হ্যাঁ।
আনোয়ারা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। বুলবুল নামটা সুন্দর। তোমার কী মনে হয় জহুর? এই বাচ্চা কি একদিন আকাশে উড়বে?
জানি না আনোয়ারা বুবু। আমি কিছুই জানি না।
আনোয়ারা বিস্ময়াভিভূত হয়ে বুলবুল নামের পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ময়কর বাচ্চাটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
২.১ সোজা হয়ে দাঁড়া দুষ্ট ছেলে
দ্বিতীয় পর্ব
আনোয়ারা বলল, সোজা হয়ে দাঁড়া দুষ্ট ছেলে। নড়বি না।
বুলবুল সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। সে তার দুই হাত তুলে দুই দিকে ছড়িয়ে রেখেছে, আনোয়ারা পুরানো কাপড় দিয়ে তার শরীরটাকে পেঁচিয়ে দিচ্ছে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর আনোয়ারা পুরানো কাপড় দিয়ে তার শরীরটা পেঁচিয়ে দেয়। বুলবুলের পিঠে পাখাগুলো বড় হয়ে। উঠছে, সেটা যেন কেউ বুঝতে না পারে সে জন্যে কাপড় দিয়ে সেটা তার শরীরের সাথে পেঁচিয়ে রাখা হয়। কাপড় দিয়ে পাখাগুলো শরীরের সাথে পেঁচানোর পরও পিঠের দিকে খানিকটা উঁচু হয়ে থাকে দেখে মনে হয় একটা কুঁজ ঠেলে উঠেছে। আনোয়ারা বুলবুলকে একটা শার্ট পরিয়ে দিয়ে বলে, মনে আছে তো সবকিছু?
আছে খালা। বুলবুল অধৈর্য হয়ে বলল, মনে থাকবে না কেন?
আনোয়ারা বলল, আমি জানি তোর মনে আছে। তারপরেও তোকে মনে করিয়ে দিই। কারো সাথে ঝগড়া করবি না, মারামারি করবি না। পানিতে নামবি না। গা থেকে শার্ট খুলবি না।