লিফট আসার পর ভেতর থেকে কয়েকজন বের হয়ে এলো, নাসরীন তখন সাবধানে লিফটের এক কোনায় গিয়ে দাঁড়ায়। ভেতরে কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়েছিল, ভাগ্যিস তাদের মাঝে পরিচিত কেউ নেই।
লিফটটা বিভিন্ন তলায় থামতে থামতে নিচে এসে দাঁড়াল। নাসরীন নিঃশব্দে নেমে আসে, গেটে কয়েকজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। নাসরীন তাদের পাশ কাটিয়ে রাস্তায় বের হয়ে এলো। বাচ্চাটাকে বের করে এখন। কোলে নিতে হবে, তারপর একটা রিক্সা কিংবা স্কুটারে করে যেতে হবে—কোথায় যেতে হবে সে এখনো জানে না।
ঠিক তখন নাসরীনের চোখ পড়ল হাসপাতালের গেটের কাছে গুটিগুটি মেরে বসে থাকা মানুষটির দিকে। জাত্র সেখানে চুপচাপ বসে আছে, কেন বসে আছে কে জানে। নাসরীন একটু এগিয়ে গেল, বলল, আপনি?
জহুর মাথা নাড়ল। ফিসফিস করে বলল, মেরে ফেলেছে?
নাসরীন মাথা নাড়ল, না।
জহুর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মেয়েটা আমাকে বাচ্চাটার দায়িত্ব। দিয়েছিল। আমি পারলাম না। আমার নিজের ভুলের জন্যে।
কী ভুল?
আপনাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম—ভেবেছিলাম—
নাসরীন একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, আমি আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছি। আমি বাচ্চাটাকে নিয়ে এসেছি।
জহুরের একটু সময় লাগল কথাটা বুঝতে। যখন বুঝতে পারল তখন। সে উঠে দাঁড়াল, খুব ধীরে ধীরে তার মুখে একটু হাসি ফুটে ওঠে, সে হাসতে অভ্যস্ত নয়, তার মুখে হাসিটাকে অত্যন্ত বেমানান মনে হয়। জহুর হাত বাড়িয়ে বলল, কোথায়?
নাসরীন হাতের পাশ থেকে ঝোলানো বালিশের ওয়ারে রাখা ছোট বাচ্চাটাকে বের করে দিল, বলল, ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। এখন উঠবে না—আপনি যত দূর সম্ভব নিয়ে যান, দেরি করবেন না।
না দেরি করব না। জহুর বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে নাসরীনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকে কী বলবে সে বুঝতে পারছে না, অনুভূতির নরম কোমল কথাগুলো সে বলতে পারে না। শেষ পর্যন্ত সেটাই সে বলল, আমি আসলে কী বলব বুঝতে পারছি না।
নাসরীন বলল, কিছু বলতে হবে না। আপনি যান। যত তাড়াতাড়ি পারেন যান।
আপনার হয়তো ঝামেলা হবে–
হলে হবে। আপনি যান।
যাচ্ছি।
নাসরীন দেখল, জহুর বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে মানুষের ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ডক্টর সেলিমকে কেমন যেন উদভ্রান্তের মতো দেখায়, সে কাঁপা গলায় বলল, তুমি কী করেছ?
আমি বাচ্চাটাকে সেই মানুষটার কাছে দিয়ে দিয়েছি।
মনে হলো ডক্টর সেলিম কথাটা ঠিক বুঝতে পারল না, কয়েকবার তার ঠোঁট নড়ল, কোনো শব্দ বের হলো না। একটু চেষ্টা করে বলল, বাচ্চাটাকে দিয়ে দিয়েছ?
হ্যাঁ।
কেন?
আপনারা যেন বাচ্চাটাকে খুন করে না ফেলেন সে জন্যে।
তুমি জান তুমি কী করেছ? তুমি জান?
নাসরীন মাথা নাড়ল, বলল, জানি। মানুষটা আমার কথা বিশ্বাস করে বাচ্চাটাকে রেখে গিয়েছিল, আমি তার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছি।
ডক্টর সেলিম হঠাৎ উন্মাদের মতো চিৎকার করে নাসরীনের দিকে এগিয়ে এলো, বলল, আমি তোমাকে খুন করে ফেলব। খুন করে ফেলব।
নাসরীন কষ্ট করে একটু হাসল, বলল, করতে চাইলে করেন স্যার। কিন্তু সেই বাচ্চাটাকে খুন করতে পারবেন না।
বাচ্চা? কিসের বাচ্চা? ওইটা কি মানুষের বাচ্চা ছিল?
জি স্যার। মানুষের বাচ্চা ছিল।
না। এটা ছিল পাখির বাচ্চা-পাখি! মানুষের বাচ্চাকে খুন করা যায় —কিন্তু পাখির বাচ্চাকে দরকার হলে কেটে কুটে দেখা যায়। বুঝেছ?
না স্যার বুঝিনি!
শুনে রাখো মেয়ে। ঐ পাখির বাচ্চাটাকে আমি খুঁজে বের করব। করবই করব। আর তোমাকে–
আমাকে স্যার?
আমি দেখব তুমি কীভাবে তোমার ক্যারিয়ার তৈরি কর। এই দেশের মাটিতে তোমাকে আমি থাকতে দিব না।
নাসরীন তার দুই হাত সামনে মেলে ধরে বলল, দেখেন স্যার।
কী দেখব?
আমার হাত! পরিষ্কার। একটু আগে মনে হচ্ছিল এখানে ছোপ ছোপ রক্ত! এখন আর নাই। আমার ক্যারিয়ারের দরকার নাই স্যার, আমি মানুষের বাসায় বাসন ধুয়ে জীবন কাটিয়ে দেব। কিন্তু রাত্রে যখন ঘুমাতে যাব দেখব আমার হাত ধবধবে পরিষ্কার। সেখান এক ফোঁটা রক্ত নাই।
ডক্টর সেলিম চিকার করে বলল, বেরিয়ে যাও। বেরিয়ে যাও তুমি আমার সামনে থেকে। এই হাসপাতালে আমি তোমার মুখ দেখতে চাই না।
নাসরীন বলল, আপনি আমার মুখ দেখবেন না স্যার। আর কোনো দিন দেখবেন না। তুরি মানে বুঝতে পারছেন তো?
কী মানে?
আপনার মুখটাও আমার আর কোনো দিন দেখতে হবে না!
হাতে একটা কুপি বাতি নিয়ে আনোয়ারা ঘরের ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল, ঘরের ভেতরে কে? জহুর নাকি?
জহুর বলল, হ্যাঁ। আনোয়ারা বুবু? তুমি?
হ্যাঁ, জহুর। তুমি হঠাৎ করে কোথা থেকে এসেছ? সন্ধ্যেবেলা দেখি তোমার ঘরে আলো, ভাবলাম কে আবার ঘরে বাতি দেয়। তোমাকে দেখব ভাবি নাই।
আমিও ভাবি নাই। বস আনোয়ারা বুবু। বসার কিছু নাই, মাটিতেই বস।
জহুর বহুদিন পর নিজের ভিটেতে ফিরে এসেছে। ফিরে এসে সন্ধ্যেবেলা ঘরে আলো জ্বালিয়েছে। আলো দেখে তার পাশের বাড়ির আনোয়ারা দেখতে এসেছে। আনোয়ারার সাথে জহুরের কোনো রক্তের সম্পর্ক নাই কিন্তু তার নিজের বোনের মতো।
আনোয়ারা কুপি বাতিটা মাটিতে রেখে দাওয়ায় হেলান দিয়ে বসে। আবছা অন্ধকারে সে জহুরকে একটু দেখার চেষ্টা করে। বিড়বিড় করে বলে, বাপ দাদার ভিটার মাঝে শেয়াল কুকুর দৌড়ায়, ব্যাপারটা ঠিক না জহুর। তোমার ভাবসাব দেখে মনে হয় দুনিয়ায় যেন কারো বউ মরে না। ঝি মরে না।