বড় বড় শক্তিশালী দুজন মানুষ কোথা থেকে এসে তখন জহুরের দুই হাত ধরে তাকে টেনে ঘরের বাইরে নিয়ে যেতে থাকে। জহুর যেতে চাচ্ছিল কিন্তু মানুষ দুজন তাকে জোর করে টেনে নিতে থাকে। দরজার কাছে জহুর একবার দাঁড়িয়ে গেল, পেছনে ঘুরে তাকিয়ে বলল, খোদা আপনাদের মাফ করবে কি না জানি না, আমি কোনোদিন আপনাদের মাফ করব না।
জহুরকে বের করে নিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ডক্টর সেলিম চুপ করে বসে রইল, তারপর একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে সবার দিকে ঘুরে তাকালো, মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, সবাইকে থ্যাংকস। কোনো ঝামেলা ছাড়াই ব্যাপারটা শেষ হয়েছে। যে রকম গোয়াড় ধরনের মানুষ আমি ভেবেছিলাম কী না কী করে।
গুরুত্বপূর্ণ চেহারার একজন মানুষ বলল, কিছু করতে পারত না, আমি সঙ্গে অনেক আর্মড গার্ড এনেছি।
আমি জানি। আপনাদের সাহায্য ছাড়া আমি একা এটা করতে পারতাম কি না জানি না। যাই হোক আপনারা একটা ঐতিহাসিক ঘটনার অংশ হয়ে থাকলেন। এই বাচ্চাটার অস্তিত্ব পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক কমিউনিটিতে একটা ঝড় তুলবে। একটা নূতন দিগন্ত তৈরি হবে। আপনারা দোয়া করবেন আমরা যেন তার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে পারি।
উপস্থিত যারা ছিল তাদের কেউ কোনো কথা বলল না, শুধু গম্ভীরভাবে কলের পুতুলের মতো মাথা নাড়ল।
১.৬ ছোট বাচ্চাটা চিৎকার করে কাঁদছে
ছোট বাচ্চাটা চিৎকার করে কাঁদছে কিন্তু কাউকেই সেটা নিয়ে বিচলিত হতে দেখা গেল না। বাচ্চাটার সারা শরীরে নানা ধরনের মনিটর লাগিয়ে তাকে উপুড় করে শুইয়ে রাখা হয়েছে, নানারকম যন্ত্রপাতিতে তার শরীরের সব ধরনের জৈবিক কাজকর্মের ওপর নজর রাখা হচ্ছে। কয়েকটা ভিডিও ক্যামেরা তার দিকে তাক করে রাখা হয়েছে। এর মাঝে তাকে নানা দিক থেকে এক্সরে করা হয়েছে, আরো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার জন্যে প্রস্তুতি চলছে।
বাচ্চার কান্নাকাটি ধীরে ধীরে নাসরীনের কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে। সে টেকনিশিয়ানকে বলল, বাচ্চাটার মনে হয় খিদে লেগেছে।
কার?
এই বাচ্চাটার।
টেকনিশিয়ানের মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে, বলে বাচ্চা? কোথায় বাচ্চা?
নাসরীন অবাক হয়ে বলল, এই যে।
টেকনিশিয়ান হা হা করে হেসে বলল, এইটা? এইটা তো মানুষের বাচ্চা না। এইটা শয়তানের বাচ্চা। মানুষের বাচ্চার কখনো পাখা থাকে?
নাসরীন অবাক হয়ে টেকনিশিয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকল, কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না। ইতস্তত করে বলল, শয়তানের বাচ্চা হলেও তো বাচ্চা। একটা বাচ্চার খিদে লাগে।
হ্যাঁ খিদে তো লাগেই। কিন্তু শয়তানের বাচ্চা কী খায় তা তো জানি না। কী খেতে দেব? রক্ত? টেকনিশিয়ানটি হা হা করে হাসতে লাগল যেন খুব একটা মজার কথা বলেছে।
নাসরীন নিঃশ্বাস বন্ধ করে ঘর থেকে বের হয়ে ডক্টর সেলিমের চেম্বারের দিকে এগিয়ে যায়। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখে ডক্টর সেলিম টেলিফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে। কথাগুলো বলছে ইংরেজিতে কাজেই মনে হয় অন্য পাশে দেশের বাইরের কোনো মানুষ।
নাসরীন শুনল ডক্টর সেলিম বলছে, তুমি ভিডিও ফুটেজটা দেখেছ? কী মনে হয়?
অন্য পাশ থেকে কী বলেছে নাসরীন শুনতে পেল না কিন্তু ডক্টর সেলিমের হা হা হাসি শুনে বুঝতে পারল কথাটি নিশ্চয়ই খুব মজার। ডক্টর সেলিম বলল, তাহলে তুমি আমার এই শয়তানের বাচ্চার একটা টুকরো চাও?… কোন টুকরা…?… উঁহু। তুমি সবকিছুর এক টুকরা পাবে না। যে কোনো একটা জায়গার একটা টুকরো। হয় ফুসফুসের একটা টুকরো, তা না হয় হৃৎপিণ্ডের, না হয় মস্তিষ্কের, না হয় লিভার কিংবা রক্তের স্যাম্পলবল তুমি কী চাও?
নাসরীনের মনে হলো হড়হড় করে সে বমি করে দেবে, কোনোমতে মুখ ঢেকে সে নিঃশব্দে বের হয়ে আসে। লাউঞ্জুের একটা চেয়ারে সে কিছুক্ষণ নিজের মাথা চেপে বসে থাকে। যে মানুষটি এই বাচ্চাটাকে নিয়ে এসেছিল সে তাহলে ঠিকই অনুমান করেছে যে বাচ্চাটিকে এরা মেরে ফেলবে। এ রকম ফুটফুটে বাচ্চাকে কেমন করে মানুষ মেরে ফেলতে পারে? কেমন করে তাকে শয়তানের বাচ্চা বলতে পারে?
নাসরীন হঠাৎ করে বুঝতে পারে তার হাতগুলো থরথর করে কাঁপছে। মানুষটি এই বাচ্চাটিকে নিয়ে চলে যেতে চেয়েছিল, নাসরীনের কথা বিশ্বাস করে রেখে গেছে। নাসরীন যদি না বলত তাহলে মানুষটা এই বাচ্চাটাকে নিয়ে যেত, বাচ্চাটা বেঁচে যেত। তার কথা বিশ্বাস করে মানুষটা বাচ্চাটাকে নিয়ে থেকে গিয়েছিল। এই ছোট শিশুটাকে হত্যা করার জন্যে যদি একটা মানুষ দায়ী হয়ে থাকে তাহলে সেটা হচ্ছে সে নিজে। নাসরীন তার হাতের দিকে তাকায়, তার মনে হতে থাকে তার হাতে বুঝি ছোপ ছোপ রক্ত।
নাসরীন হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, তার মুখ শক্ত হয়ে যায়। সে একজন। ডাক্তার, মানুষকে বাঁচানোর জন্যে সে শপথ নিয়েছে, মানুষকে হত্যা করার জন্যে নয়। যেভাবে হোক তার বাচ্চাটাকে বাঁচাতে হবে। নাসরীন লাউঞ্জ থেকে বের হয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে আবার আইসি, ইউনিটের দিকে উঁকি দিল, একটু আগেই বাচ্চাটা চিৎকার করে কাঁদছিল এখন নেতিয়ে ঘুমিয়ে আছে। নাসরীন জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? বাচ্চাটা ঘুমুচ্ছে কেন?
ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছি। চিৎকার করে কানের পর্দা ফাটিয়ে দিয়েছিল। ফুসফুসে কী জোর বাবারে বাবা।
ইনজেকশন? কীসের ইনজেকশন?
ঘুম। কিছুক্ষণ ঘুমাক শয়তানের বাচ্চা। আমরা একটু খেয়ে আসি।
মানুষগুলো বের হওয়ার সাথে সাথে নাসরীনের হঠাৎ মনে হলো বাচ্চাটাকে বাঁচানোর সে একটা সুযোগ পেয়েছে। দৈব সুযোগ। শুধু সেই পারবে বাচ্চাটাকে এখান থেকে বের করতে। সে বিছানার কাছে ছুটে গেল, বাচ্চাটার শরীরে লাগানো নানা ধরনের মনিটরগুলো খোলার আগে সে অ্যালার্মগুলো বিকল করে দিল। বাচ্চাটা পাখির পালকের মতো হালকা, একটা বালিশের ওয়ার খুলে তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে সে তার ঘাড়ে ঝুলিয়ে নিয়ে উপরে তার অ্যাপ্রনটা পরে নেয়। কেউ যদি সন্দেহ করে তাকে সার্চ করে শুধু তাহলেই বাচ্চাটাকে পাবে। নাসরীন আই.সি.ইউ থেকে বের হয়ে করিডোর ধরে হাঁটতে থাকে। লিফটের কাছে এসে বোতাম টিপে সে অপেক্ষা করেনাসরীনের মনে হয় লিফটটা আসতে বুঝি কয়েক যুগ সময় লেগে যাচ্ছে। ছোট বাচ্চাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। হঠাৎ করে উঠে চিৎকার করে কঁাদা শুরু করার সম্ভাবনা নেই, তবু তার বুক ধ্বক ধ্বক করতে থাকে।