শুধু ডাক্তার না, কোনো মানুষও দেখে নাই।
ডক্টর সেলিমের চোখ দুটি চকচক করে ওঠে, কোনো মানুষ দেখে নাই?
নাহ। জহুর ইতস্তত করে বলল, বুঝতেই পারছেন। এই বাচ্চাটাকে কেউ দেখলেই হইচই শুরু করে দেবে।
ডক্টর সেলিম মাথা নাড়ল, বলল, সেটা আপনি ঠিকই বলেছেন। আপনি আর কাউকে না দেখিয়ে যে আমার কাছে এনেছেন সেটা ঠিকই করেছেন।
জহুর বলল, জি। আমি চাই না এটা জানাজানি হোক। যাই হোক আমি আপনার কাছে একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে এসেছি।
কী উদ্দেশ্য।
জহুর বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি এর ডানা দুটি কেটে দিবেন।
ডক্টর সেলিম একটু চমকে উঠল, কেটে দিব?
জি স্যার। এর পাখা দুটি কেটে দিলে তাকে নিয়ে কেউ কোনো কথা বলবে না। তা না হলে এর জীবনটা অসহ্য হয়ে উঠবে।
ডক্টর সেলিম সাবধানে বাচ্চাটার পাখাটা স্পর্শ করে জুহুৱের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন। পাখা নিয়ে বড় হলে এর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে।
এই অপারেশন করতে কত লাগবে আমাকে বলবেন? আমি খুব গরিব মানুষ, অনেক কষ্টে কিছু টাকার ব্যবস্থা করেছি।
ডক্টর সেলিম বলল, আরে! কী বলছেন আপনি। এই বাচ্চাটাকে ঠিক করে দেয়ার টাকা নিয়ে আপনি মাথা ঘামাচ্ছেন?
জহুর ডক্টর সেলিমের মুখের দিকে তাকালো, হঠাৎ করে সে বুঝতে পারল এই মানুষটি আসলে তার সাথে মিথ্যা কথা বলছে। বাচ্চাটার অপারেশন করা থেকে অন্য কিছুতে তার আগ্রহ বেশি। সাথে সাথে তার মুখ কঠিন হয়ে যায়। সে শীতল গলায় বলল, ডাক্তার সাহেব।
বলেন।
আপনি আমাকে বলেন কত খরচ হবে। আমি তারপর অন্য কোনো ডাক্তারের কাছে যাব।
ডক্টর সেলিম ভুরু কুঁচকে বলল, কেন? অন্য কোনো ডাক্তারের কাছে কেন?
একটা বাচ্চার পিঠে পাখা থাকাটা স্বাভাবিক ব্যাপার না, সেটা কয়েকজনকে দেখিয়ে ঠিক করা ভালো।
ডক্টর সেলিম কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন দরজায় শব্দ হলো, মেয়ের গলায় কেউ একজন বলল, স্যার।
ডক্টর সেলিম অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে একটা টাওয়েল দিয়ে বাচ্চাটার ঘাড় পর্যন্ত ঢেকে দিয়ে বলল, কে? নাসরীন?
জি স্যার। ডক্টর সেলিম কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তাকে কোনো সুযোগ না দিয়ে কম বয়সী একটা মেয়ে ডক্টর সেলিমের চেম্বারে ঢুকে গেল। তার শরীরে ডাক্তারের সবুজ রঙের অ্যাপ্রন, গলায় স্টেথিস্কোপ। চোখে চশমা, চেহারায় কেমন জানি এক ধরনের সজীবতা রয়েছে।
ডক্টর সেলিম বলল, কী ব্যাপার?।
নাসরীন নামের ডাক্তার মেয়েটা বলল, চার নম্বর কেবিনের বাচ্চাটা। আমার মনে হয় সার্জারি না করাটাই ঠিক হবে যেহেতু ফিফটি ফিফটি চান্স, ফেমিলির ওপর বার্ডেন না দেয়াই ভালো।
ডক্টর সেলিম কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, সেই মুহূর্তে নাসরীন হঠাৎ করে ক্যাবিনেটে শুইয়ে রাখা বাচ্চাটাকে দেখে এবং সাথে সাথে তার মুখে মধুর এক ধরনের হাসি ছড়িয়ে পড়ে। সে কাছে এগিয়ে বলে, ও মা! কী সুন্দর বাচ্চাটা! একেবারে পরীর মতো চেহারা!
ডক্টর সেলিম হাত দিয়ে নাসরীনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, কাছে যেয়ো না।
নাসরীন অবাক হয়ে বলল, কেন স্যার?
ডক্টর সেলিম আমতা আমতা করে বলল, এটা স্পেশাল কেস। এটার জন্যে বিশেষ একটা ব্যবস্থা দরকার।
নাসরীন জহুরের দিকে তাকালো, জিজ্ঞেস করল, স্পেশাল কেস? কী হয়েছে?
জহুর মেয়েটির মুখের দিকে তাকায় এবং হঠাৎ করে কেমন যেন আশ্বস্ত অনুভব করে। সে এগিয়ে গিয়ে বলল, আপা। আপনিও দেখেন।
ডক্টর সেলিম জহুরকে থামানোর চেষ্টা করল, কিন্তু জহুর তাকে ঠেলে সরিয়ে কাছে গিয়ে বাচ্চাটার উপর থেকে টাওয়েলটা সরিয়ে নেয়।
নাসরীন বাচ্চাটাকে দেখে বিস্ময়ে একটা চিৎকার করে ওঠে। অনেকক্ষণ সে দুই হাতে নিজের মুখ ঢেকে রাখে, তারপর কাছে গিয়ে প্রথমে তাকে আলতোভাবে স্পর্শ করে, তারপর সাবধানে তাকে কোলে তুলে নেয়। বাচ্চাটি নাসরীনকে দেখে তার দাঁতহীন মুখে একটা হাসি দিয়ে হাত বাড়িয়ে তার চশমাটা ধরার চেষ্টা করল।
কয়েক মুহূর্ত নাসরীন কোনো কথা বলতে পারল না, তারপর একটু চেষ্টা করে বলল, একেবারে পাখির পালকের মতো হালকা!
জহুর মাথা নাড়ল, কি আপা। একেবারে হালকা, কিন্তু বাচ্চাটা অনেক শক্ত।
এটা কার বাচ্চা?
জহুর বলল, সেটা অনেক লম্বা ইতিহাস।
নাসরীনের ইতিহাসটা শোনার কৌতূহলের অভাব নেই, জিজ্ঞেস করল, কী ইতিহাস শুনি। বলেন।
ডক্টর সেলিম এই বারে বাধা দিল, বলল, নাসরীন, তুমি বাচ্চাটাকে ক্যাবিনেটে রেখে দাও। আর খবরদার এর কথা কাউকে বলবে না। কাউকে না। নেভার।
নাসরীন সাবধানে বাচ্চাটাকে ক্যাবিনেটে রেখে বলল, ঠিক আছে স্যার বলব না। কিন্তু স্যার এটা কেমন করে সম্ভব?
সেটা আমি এখনো জানি না, কিন্তু দেখতেই পাচ্ছ এটা সম্ভব।
জহুর নাসরীনের দিকে তাকিয়ে বলল, আপা। আপনিও তো ডাক্তার। তাই না?
হ্যাঁ। আমিও ডাক্তার তবে খুবই ছোট ডাক্তার। মাত্র পাস করেছি। সে ডক্টর সেলিমকে দেখিয়ে বলল, স্যার আমাদের মাঝে সবচেয়ে বড় ডাক্তার। ডাক্তারদেরও ডাক্তার।
জহুর কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে বড় ডাক্তারের চেয়ে এই ছোট ডাক্তারের মাঝে এক ধরনের ভরসা খুঁজে পেল। সে নিচু গলায় বলল, আপা। এই বাচ্চাটার ডানা দুটি আমি অপারেশন করে কাটতে চাই–
নাসরীন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আপনি আমাদের কাছে এনেছেন, যেটা তার জন্যে ভালো হয় সেটাই করা হবে।
জহুর সাথে সাথে কেমন করে জানি বুঝতে পারল এই মেয়েটি যে কথাগুলো বলছে সেটা সে সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেই বলছে। সে এবারে ঘুরে নাসরীনের দিকে তাকালো, বলল, আপা আমি অনেক চিন্তা করে দেখেছি। এই ছেলেটার জন্যে এই পাখা দুইটা কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনো গতি নাই। যদি তার পাখা থাকে সে হবে একটা চিড়িয়া। যেই তাকে দেখবে সেই তাকে ধরে সার্কাসে বিক্রি করে দেবার চেষ্টা করবে।