জহুর মেয়েটির কাছে গিয়ে তার হাতটি ধরল। হাতটি শীতল এবং ঘামে ভেজা, জহুর বুঝতে পারে হাতটি থরথর করে কাঁপছে। সে নরম গলায় বলল, তোমার কোনো ভয় নেই, মা।
মেয়েটি ফিসফিস করে বলল, আমি মারা যাচ্ছি।
তুমি মোটেই মারা যাচ্ছ না। তুমি তোমার শরীরে যে বাচ্চাটা আছে তার জন্ম দিতে যাচ্ছ।
মেয়েটা দাঁতে দাঁত কামড়ে ধরে থরথর করে কাপতে থাকে। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে ওঠে। জহুর মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, সে দুই দিন আগেও এই মেয়েটার কথা জানত না, এই মেয়েটাকে চিনত না। সে এখনো এই মেয়েটির নাম পর্যন্ত জানে না, অথচ এই দুর্ভাগা মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে সে বুকের ভেতর গভীর বেদনা অনুভব করছে। তার ইচ্ছে করছে তার সকল যন্ত্রণা সকল কষ্ট নিয়ে নিতে—সেটি সম্ভব নয়, তাই সে মেয়েটির হাত শক্ত করে ধরে রাখল।
নবজাতক একটা শিশুর তীক্ষ্ণ কান্না কানে যেতেই মেয়েটি দুই হাতে তার মুখ ঢেকে বলল, সরিয়ে নিয়ে যাও। এই রাক্ষসটাকে সরিয়ে নিয়ে যাও।
রক্ত এবং ক্লেদে মাখা শিশুটার দিকে জহুর বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। ফুটফুটে ফুলের মতো অনিন্দ্য সুন্দর একটা শিশু, মাথায় রেশমের মতো চুল, বড় বড় চোখ, টিকালো নাক, ছোট ছোট হাত-পা। উপুড় হয়ে রক্ত এবং ক্লেদে পড়েছিল, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পিঠে দুটো ছোট ছোট পাখা। হাত এবং পায়ের সাথে সাথে তার পাখাগুলো তিরতির করে নড়ছে। জহুর এগিয়ে গিয়ে শিশুটিকে তুলে নেয়—শিশুটি পাখির পালকের মতো হালকা।
মেয়েটি মুখ ঢেকে চিৎকার করে বলল, সরিয়ে নাও। সরিয়ে নাও!
জহুর তার শটটা খুলে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে নেয়, তারপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, দেখো! দেখো বাচ্চাটাকে। কী সুন্দর!
মেয়েটি খুব ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে তাকালো এবং এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে অনিন্দ্য সুন্দরা শিশুটির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর খুব সাবধানে শিশুটির হাতটা স্পর্শ করে বলল, সব কিছু ঠিক আছে?
হ্যাঁ আছে।
আঙুলগুলি?
জহুর ঠিক বুঝতে পারল না এই মেয়েটি শিশুটির সবকিছু ভুলে শুধু আঙুলগুলোর কথা কেন জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু সে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না, বলল, হ্যাঁ। ঠিক আছে।
মনে হলো আঙুলগুলো ঠিক আছে শুনেই মেয়েটির সব দুশ্চিন্তার যেন অবসান হয়ে গেল। সে চোখ বন্ধ করে আছে এবং এই প্রথমবার তার মুখে খুব সূক্ষ্ম একটা হাসি ফুটে ওঠে। জহুর ঠিক বুঝতে পারল না এই শিশুটির পিঠে ছোট দুটি পাখা আছে সেটি এখন তাকে বলবে কি না—কী ভেবে শেষ পর্যন্ত জহুর সেটি বলল না। জহুর লক্ষ করল মেয়েটি ফিসফিস করে কিছু বলছে, জহুর নিচু হয়ে তার মুখের কাছে তার মাথাটি নামিয়ে আনে, শুনতে পায় মেয়েটি ফিসফিস করে বলছে, আমি মারা যাচ্ছি। তুমি আমার ছেলেটিকে দেখে রেখো?
জহুর বলল, না। তুমি মারা যাবে না। তুমি বেঁচে থাকবে।
মেয়েটি ফিসফিস করে বলল, আমি মারা যাচ্ছি।
সত্যি সত্যি মেয়েটি মারা গেল সূর্য ডোবার আগে। পাখির পালকের মতো হালকা শিশুটাকে বুকে জড়িয়ে রেখে জহুর মেয়েটার মাথার কাছে বসে রইল।
হঠাৎ করে সে আবিষ্কার করল, মেয়েটার নামটি তার জানা হয়নি।
১.৫ ডক্টর সেলিম
ডক্টর সেলিম বিস্ফারিত চোখে কেবিনেটে উপুড় করে রাখা শিশুটির দিকে তাকিয়ে রইল। ছোট বাচ্চাটি তার মাথাটি উঁচু করার চেষ্টা করছে, ঘাড় এখনো শক্ত হয়নি তাই মাথাটা অল্প অল্প দুলছে। একটা হাতে নিজেকে ভর দিয়ে রেখেছে, অন্য হাতটা নিজের মুখে। ছোট মুখে তার হাতটা ঢোকানো সম্ভব নয়, বাচ্চাটি সেটা জানে না, সে প্রাণপণে সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছে। তার বড় বড় চোখ, সে সামনে তাকিয়ে আছে কিন্তু আলাদা করে কিছু একটা দেখছে বলে মনে হয় না।
ডক্টর সেলিম অবশ্যি ছোট শিশুটির এসব কিছুই দেখছিল না, সে হতবাক হয়ে বাচ্চাটির পিঠের দিকে তাকিয়ে ছিল, সেখানে ছোট ছোট দুটি পাখা এবং পাখাগুলো মাঝে মাঝে নড়ছে। ডক্টর সেলিম সাবধানে একটা পাখাকে স্পর্শ করতেই পাখাটা একটা ছোট ঝাঁপটা দিল এবং ডক্টর সেলিম সাথে সাথে তার হাত সরিয়ে নিল। সে ঝুঁকে পড়ে পিঠের ঠিক যেখান থেকে পাখাটা বের হয়ে এসেছে সে জায়গাটুকু লক্ষ করল, তারপর সোজা হয়ে। দাঁড়িয়ে জহুরের দিকে তাকিয়ে বলল, এটা কার বাচ্চা? কোথা থেকে এসেছে?
বাচ্চার দায়িত্ব কার, সেটা যদি জিজ্ঞেস করেন তাহলে বলা যায় দায়িত্ব আমার।
বাচ্চাটার পাখা কোথা থেকে এসেছে?
জহুর জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, সেইটা অনেক বড় ইতিহাস।
ইতিহাসটা কী? বাচ্চাটা কার? বাবা-মা কে?
বাবা নাই। টেস্টটিউব বেবি না কী বলে সেইটা—আপনারা ভালো বুঝবেন। আর মা–
মা?
মা মারা গেছে। বাচ্চাটা জন্ম দেয়ার পরই মারা গেছে। মারা যাওয়ার সময় আমার হাত ধরে আমাকে বাচ্চাটা দিয়ে গেছে। বলেছে দেখে শুনে রাখতে। বলেছে—
শিশুটির মা মৃত্যুর ঠিক আগে জহুরকে কী বলে গেছে ডক্টর সেলিম সেটা শুনতে কোনো আগ্রহ দেখাল না, জিজ্ঞেস করল, এই বাচ্চাটাকে দেখে ডাক্তাররা কী বলেছে?
জহুর বলল, কোনো ডাক্তার বাচ্চাটারে দেখে নাই। আপনি প্রথম।
ডক্টর সেলিম কেমন যেন চমকে উঠল, বলল, আমি প্রথম? এর আগে কেউ দেখে নাই?
না।
বাচ্চাটার যখন জন্ম হয়—
কেউ ছিল না। শুধু আমি।
শুধু আপনি? কেন?
জহুর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সেটা অনেক লম্বা ইতিহাস।
ডক্টর সেলিমের লম্বা ইতিহাস শোনার ধৈর্য নেই, জিজ্ঞেস করল, আমার আগে কোনো ডাক্তার এই বাচ্চাকে দেখে নাই?