মেয়েটা তীব্র দৃষ্টিতে জহুরের দিকে তাকিয়ে থেকে কাশতে কাশতে বলল, আমাকে কেন তুলে এনেছ?
জহুর মুখে হাসি ধরে রেখে বলল, কেন আনব না? একজন মানুষ পানিতে ড়ুবে মারা যাবে আর আমি সেটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব, সেটা তো হতে পারে না।
মেয়েটা চোখ বন্ধ করে বলল, আমাকে মরে যেতে হবে। আমাকে এক্ষুনি মরে যেতে হবে।
কেন?
আমার পেটের ভেতরে একটা রাক্ষস। কিলবিল কিলবিল করছে বের হওয়ার জন্যে। বের হয়ে সে সবাইকে মেরে ফেলবে। সে বের হবার আগে আমাকে মরে যেতে হবে যেন সে বের হতে না পারে।
জহুর কী বলবে ঠিক বুঝতে পারল না, ইতস্তত করে বলল, তুমি এসব কী বলছ?
আমি সত্যি বলছি। পারুলের পেটে একটা বাচ্চা ছিল তার অর্ধেকটা মানুষ অর্ধেকটা সাপের মতো। রাহেলরি পেটে একটা রাক্ষস ছিল তার দুইটা মাথা এত বড় বড় দাঁত। বিলকিসের পেটের বাচ্চাটার ছিল লম্বা লম্বা শুঁড়। আমার পেটের বাচ্চাটা শকুনের মতো—
ছি! তুমি কী বলছ এসব। তোমাদের নিয়ে চিকিৎসা করে সবকিছু ঠিক করে দেবে।
মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, আমাদের কেমন করে চিকিৎসা করবে? আমাদের বিয়ে হয়নি পেটে বাচ্চা এসেছে, আমরা সব হচ্ছি শয়তানি। আমরা সব রাক্ষুসী। আমরা সব—
মেয়েটা হঠাৎ বিকারগ্রস্ত মানুষের মতো কাঁদতে শুরু করে। জহুর কী করবে ঠিক বুঝতে পারে না। সে বহুদিন নরম গলায় কারো সাথে কথা বলেনি, কোমল গলায় কাউকে সান্ত্বনা দেয়নি। কেমন করে দিতে হয় সে ভুলেই গেছে। কী করবে বুঝতে না পেরে সে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, দেখবে তুমি সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।
হবে না। হবে না। হবে না—
হবে। জহুর জোর গলায় বলল, আমার একটা মেয়ে ছিল তোমার মতোন, তাকে আমি বাঁচাতে পারি নাই। বেঁচে থাকলে সে এখন তোমার বয়সী হতো। তুমি আমার সেই মেয়ের মতোন, আমি তোমাকে আমার মেয়ের মতোন রাখব।
মেয়েটি হঠাৎ ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে শুরু করে। জহুর কী করবে বুঝতে না পেরে মেয়েটাকে শক্ত করে ধরে রাখল।
মেয়েটি হাসপাতালের ভেতর ঢুকতে রাজি হয়নি বলে জহুর তাকে মারকেল গাছের নিচে একটা বিছানা করে দিল। শুকনো কাপড় পরিয়ে একটা কম্বল দিয়ে তাকে বুক পর্যন্ত ঢেকে দিয়েছে, সে শক্ত করে কম্বলটা ধরে উদভ্রান্তে র মতো সামনে কোথায় জানি তাকিয়ে রইল। জহুর মেয়েটার কাছে চুপচাপ বসে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে, হঠাৎ করে মেয়েটি কেন জানি চুপ করে গেছে।
জহুর বলল, মানুষের জীবনে আসলে অনেক দুঃখ-কষ্ট আসে। ধৈর্য ধরে সেইগুলো সহ্য করতে হয়। যদি মানুষ সেটা সহ্য করে তাহলে দেখবে সবকিছু ঠিক হয়ে যায়।
মেয়েটা জহুরের কথা শুনতে পেল কি না বোঝা গেল না সে একদৃষ্টে বহুদূরে তাকিয়ে রইল। জহুর বলল, তুমি একটু বিশ্রাম নাও। এই দ্বীপটাতে এখন কেউ নাই, শুধু তুমি আর আমি। একটু পরে নিশ্চয়ই কেউ আসবে তখন আমরা যাব। তোমার কোনো ভয় নাই। বড় বড় ডাক্তারের তোমাকে দেখবে। তোমার চিকিৎসা হবে।
মেয়েটা এবারেও কোনো কথা বলল না। জহুর বলল, তুমি যদি আমাকে তোমার বাড়ির ঠিকানা দাও তাহলে আমি তোমার বাবা-মা আত্মীয়-স্বজনকে খবর দিতে পারি, তারা এসে তোমাকে নিয়ে যাবে। একটু থেমে যোগ করল, এখন যদি তাদের কাছে যেতে না চাও তুমি ইচ্ছা করলে আমার সাথেও থাকতে পার। আমার সংসার ঘর বাড়ি কিছু নাই, তুমি হবে আমার মেয়ে। আমার সাথে তুমি থাকবে—
মেয়েটা হঠাৎ যন্ত্রণার মতো একটা শব্দ করল। জহুর চমকে তার দিকে তাকায়, মেয়েটার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে আছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, সে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। জহুর তার হাত ধরে বলল, কী হয়েছে?
মেয়েটা ফিসফিস করে বলল, আমি মরে যাচ্ছি।
কেন তুমি মরে যাবে?
ব্যথা। মেয়েটা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল, ভয়ানক ব্যথা।
কোথায় ব্যথা?
পেটে।
ব্যথাটা কী আসছে যাচ্ছে?
মেয়েটা মাথা নাড়ল। জহুর জিজ্ঞেস করল, একটু পরে পরে আসছে? আস্তে আস্তে ব্যথাটা বাড়ছে?
মেয়েটা আবার মাথা নাড়ল।
জহুর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। এই মেয়েটি এখন তার পেটে ধরে রাখা সন্তানটি জন্ম দিতে যাচ্ছে। উক্টর কাদের তার ভয়ঙ্কর গবেষণা করে এই অসহায় মেয়েটির পেটে যে হতভাগ্য একটা শিশুর জন্ম দিয়েছে সেই শিশুটি এখন পৃথিবীতে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে। মানুষের জন্ম প্রক্রিয়াটি সহজ নয়, এর মাঝে কষ্ট আছে, যন্ত্রণা আছে এবং মনে হয় খানিকটা বিপদের আশঙ্কাও আছে। সন্তান জন্ম হওয়ার পর সন্তানটিকে দেখে সেই দুঃখ-কষ্ট আর বিপদের কথা মায়েরা ভুলে যায়। এই মেয়েটির বেলায় সেই কথাটি সত্যি নয়। এই মেয়েটি কষ্ট আর যন্ত্রণার মাঝে দিয়ে যাবে। তারপর যে শিশুটির জন্ম নেবে তাকে দেখে তার কষ্ট আর যন্ত্রণা সে ভুলতে পারবে না। সবচেয়ে ভয়ের কথা, এই মেয়েটি এখন যে বিকলাঙ্গ এবং ভয়াবহ শিশুটির জন্ম দেবে তাকে জন্ম দিতে সাহায্য করার জন্য কোনো ডাক্তার দূরে থাকুক একজন ধাত্রীও নেই। এমন কি একজন মহিলা পর্যন্ত নেই। মেয়েটি কীভাবে তার সন্তানের জন্ম দেবে জহুর জানে না। জন্মানোর পর সেই বিকলাঙ্গ শিশুটিকে নিয়ে সে কী করবে? সেই শিশুটিকে দেখে এই মেয়েটির কী প্রতিক্রিয়া হবে?
জহুর তার মাথা থেকে সব চিন্তা দূর করে দিল। সন্তান জন্ম দেয়ার সময় কী কী করতে হয় তার কিছু জানা নেই। যদি সত্যি সত্যি একটা মানব শিশু জন্ম নিত তাহলে তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে কিছু ব্যাপার করার দরকার হতো, নাড়ি কাটতে হতো, গরম কাপড়ে জড়িয়ে রাখতে হতো, খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হতো। কিন্তু এখন সেসব কিছু নিয়ে তার মাথা ঘামাতে হবে না। বিকলাঙ্গ একটা মাংসপিণ্ড জন্ম দেয়ার পর মেয়েটিকে সুস্থ রাখাই হবে তার একমাত্র দায়িত্ব। তখন কী করতে হাবে সে কিছু জানে না, কিন্তু মানুষ অত্যন্ত বিচিত্র একটা প্রাণী, কখন কী করতে হয় না জানলেও তারা সেটা কীভাবে কীভাবে জানি বের করে ফেলতে পারে। জহুর সেটা বের করে ফেলবে।