জহুর ঠিক বুঝতে পারল না, জিজ্ঞেস করল, কী বললেন?
বলেছি ইকারাস।
ইকারাস কী?
ডক্টর কাদের তার রক্তাক্ত মুখে অসুস্থ মানুষের মতো হাসার চেষ্টা করল, কোনো উত্তর দিল না।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, ইকারাস হচ্ছে গ্রিক মাইখোলজির একটা চরিত্র। পাখির পালক লাগিয়ে সূর্যের কাছাকাছি উড়ে গিয়েছিল।
১.৪ জাহাজের ডেকে মেয়েগুলো
জাহাজের ডেকে মেয়েগুলো শুয়ে-বসে আছে। তারা কাছাকাছি থাকলেও কেউ কারো সাথে কথা বলছে না, হাঁটুর ওপর মুখ রেখে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দুই একজন রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটে উঠছে, এই আলোতে সমুদ্রটিকে কেমন যেন রহস্যময় মনে হয়।
জহুর তিনশ তেত্রিশ নম্বর কেবিনের মেয়েটিকে খুঁজে বের করল-সেও রেলিংয়ে কনুই রেখে শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। মেয়েটির চেহারায় এক ধরনের গভীর বিষাদের চিত্র, ঠিক কী কারণে জানা নেই তাকে দেখলেই জহুরের বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে।
জাহাজের কর্কশ ভেঁপু বেজে ওঠে এবং প্রায় সাথে সাথেই তার। ইঞ্জিনগুলো চালু হয়ে যায়, জহুঁ ডেকে দাঁড়িয়ে ইঞ্জিনের মৃদু কম্পনটুকু অনুভব করল। ঘরঘর শব্দ করে জেটি থেকে সিঁড়িটা সরিয়ে নেয়া হয়, সেনাবাহিনীর একজন মানুষ মোটা দড়ির বাঁধন খুলে জাহাজটিকে মুক্ত করে দেয়। জাহাজের প্রপেলার পেছনে পানির একটা প্রবল ঢেউয়ের জন্ম দিয়ে নড়ে উঠল।
তিনশ তেত্রিশ নম্বর কেবিনের মেয়েটি হঠাৎ করে কেমন যেন একটু চঞ্চল হয়ে ওঠে, সে সতর্ক দৃষ্টিতে এদিকে সেদিকে তাকালো, তারপর খুব শান্তভাবে ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যায়।
জহুর একটু অবাক হয়ে মেয়েটির পেছনে পেছনে এগিয়ে যায়। মেয়েটি সবার চোখ এড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে থাকে—আলাদা করে কেউ তাকে লক্ষ করল না। জহুর একটু দ্রুত পা চালিয়ে তার কাছাকাছি পৌঁছানোর চেষ্টা করল কিন্তু মেয়েটি দ্রুত নিচে নেমে ইঞ্জিন ঘরের পাশে দিয়ে জাহাজের পেছনে পৌঁছে গেল। এখানে রেলিং নেই এবং জায়গাটা বেশ বিপজ্জনক। কেউ অসতর্ক হলে পেছনে পানির প্রবল আলোড়নের ভেতর মুহূর্তের মাঝে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। জায়গাটি নির্জন, মেয়েটি সেখানে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে—ভোররাতের আবছা আলোতে দৃশ্যটিকে জহুরের কাছে কেমন জানি পরাবাস্তব মনে হতে থাকে।
জহুর পায়ে পায়ে মেয়েটির কাছে এগিয়ে যেতে থাকে-হঠাৎ করে তার মাথায় একটা ভয়ঙ্কর চিন্তার কথা উঁকি দিতে শুরু করেছে।
জাহাজটা খুব ধীরে ধীরে ঘুরে যাচ্ছে, একই সাথে গতি সঞ্চয় করতে শুরু করেছে, জেটি থেকে এটা এর মাঝে বেশ খানিকটা সরে এসেছে। মেয়েটি একবার উপরে আকাশের দিকে তাকালো, দুই হাত বুকের কাছে নিয়ে এলো তারপর কিছু বোঝার আগেই সে হঠাৎ করে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। জহুর একটা চিৎকার করে সামনে ছুটে গেল কিন্তু ইঞ্জিনঘরের বিকট শব্দে কেউ তার চিৎকারটি শুনতে পেল না। জহুর জাহাজের শেষে ছুটে গিয়ে পানির দিকে তাকালো, ঘোলা পানির আবর্তনে মেয়েটির শরীরটা এক মুহূর্তের জন্যে ভেসে উঠে আবার পানির নিচে অদৃশ্য হয়ে যায়। জহুর একবার পানির দিকে তাকালো একবার জাহাজটির দিকে তাকালো, সে ছুটে গিয়ে কাউকে বলে জাহাজটি থামাতে থামাতে এই হতভাগা মেয়েটি পানিতে ড়ুবে যাবে। জহুর ঠান্ডা মাথার মানুষ, কখনোই সে বিচলিত হয় না, আজকেও হলো না। মেয়েটাকে বাঁচাতে হলে কিছু একটা করতে হবে, তারপরেও তাকে বাঁচানো যাবে কি না কেউ জানে না। কিন্তু কিছু করা না হলে মেয়েটি নিশ্চিতভাবেই মারা যাবে তাই জহুর এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। জাহাজটি তখন বেগ সঞ্চয় করে সামনে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে, সেখানে কেউ জানতেও পারল না এখান থেকে দুজন মানুষ পর পর সমুদ্রের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। একজন আত্মহত্যা করতে, অন্যজন তাকে উদ্ধার করতে।
জহুর পানির প্রবল আলোড়নের ভেতর থেকে বের হয়ে দ্রুত সাঁতার কেটে সামনে এগিয়ে যায়, মেয়েটিকে বাঁচাতে হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার কাছে পৌঁছাতে হবে। পানি থেকে মাথা বের করে সে একবার চারপাশে দেখার চেষ্টা করল, পানির ঢেউ ছাড়া সে আর কিছুই দেখতে পেল না। জহুর পানিতে ড়ুব দিয়ে দ্রুত আরেকটু সামনে এগিয়ে গিয়ে আবার মাথা তুলে তাকালো—কেউ কোথাও নেই। জহুর আরো একটু এগিয়ে আবার মাথা তুলে তাকালো। এবারে হঠাৎ করে তার মনে হলো বাম দিকে পানির ভেতর সে খানিকটা আলোড়ন দেখতে পেয়েছে। সেটি সত্যিই মেয়েটি কি না বা এটি চোখের ভুল কি না জহুর সেটি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে দ্রুত সেদিকে এগিয়ে গেল—সে দুই হাত নেড়ে অদৃশ্য কিছু খুঁজতে থাকে এবং হঠাৎ করে তার হাত একজন মানুষের শরীর স্পর্শ করে। জহুর সাথে সাথে তাকে জাপটে ধরে পানির ওপর টেনে আনে। মেয়েটির শরীর নেতিয়ে আছে, জহুর তাকে তুলে ধরে তার মুখের দিকে তাকালো, চোখ দুটো বন্ধ এবং মুখে প্রাণের চিহ্ন নেই। জহুর সেটা নিয়ে মাথা ঘামালো না, মেয়েটাকে চিৎ করে ভাসিয়ে তীরের দিকে সাঁতরাতে থাকে।
সমুদ্রের তীরে এসে সে মেয়েটাকে পাজাকোলা করে এনে বালুবেলায়। শুইয়ে দেয়। মেয়েটা নিঃশ্বাস নিচ্ছে কি না ভালো করে বোঝা গেল না, জহুর তার মাথাটা একটু ঘুরিয়ে দেয়, যেন নিঃশ্বাস নেয়া সহজ হয়। তারপর তাকে ধরে একটা ছোট ঝাকুনি দিল, ঠিক তখন মেয়েটি খকখক করে কেশে নড়ে ওঠে। জহুর মেয়েটাকে একটু সোজা করে বসিয়ে দেয়, কাশতে কাশতে মেয়েটা বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে চোখ খুলে তাকালো, তাকিয়ে জহুরকে দেখে সে একটা আর্ত চিৎকার করে ওঠে। জহুর জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, তোমার কোনো ভয় নেই মেয়ে।