ইরন একটি নিশ্বাস ফেলল এবং ঠিক তখন টেকনিশিয়ান মেয়েটি তার হাতে হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়ে ফিসফিস করে বলল, তোমার যাত্রা শুভ হোক, ইরন।
ইরন মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, তোমার কথা সত্যি হোক মেয়ে?
মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে কোথায় একটা সুইচ টিপে দিতেই খুব ধীরে ধীরে স্টেইনলেস স্টিলের ঢাকনাটা ধীরে ধীরে নিচে নেমে এল, সাথে সাথে ভিতরে আবছা অন্ধকার হয়ে আসে। পায়ের কাছে কোনো এক জায়গা থেকে মিষ্টি গন্ধের এক ধরনের শীতল বাতাস এসে ক্যাপসুলের ভিতরটা শীতল করে দিতে শুরু করেছে। ইরন হাত বাড়িয়ে মাথার কাছে নীলাভ স্ক্রিনটা চালু করে দিতেই মহাকাশযানের ভিতরটা দেখতে পেল। টেকনিশিয়ানরা চারটি ক্যাপসুল বন্ধ করে কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়েছে, সবকিছু শেষবার পরীক্ষা করে তারা নেমে যেতে শুরু করে। গোলাকার দরজা দিয়ে মাথা নিচু করে বের হয়ে যেতেই ঘরঘর শব্দ করে দরজাটা বন্ধ হয়ে তাদেরকে বাইরের পৃথিবী থেকে আলাদা করে ফেলল। ইরন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কে জানে সে আবার কখনো পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবে কি না।
ইরন একটা মৃদু কম্পন অনুভব করে। নিশ্চয়ই মহাকাশযানের বিশাল শক্তিশালী ইঞ্জিনগুলো চালু হতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মাঝেই আয়োনিত গ্যাসের প্রবাহে বিস্তৃত প্রান্তর ভস্মীভূত হয়ে যাবে। ইরন তার মুখের সামনে নীল স্ক্রিনটির দিকে তাকিয়ে থাকে, ইচ্ছে করলে সে এখানে দৃশ্যটি পাল্টে দিয়ে বাইরে থেকে মহাকাশযানটি কেমন দেখায় সেটি দেখতে পারে। ইচ্ছে করলে অন্য ক্যাপসুলগুলোতে সবাই কেমন আছে সেটাও দেখতে পারে। ইচ্ছে করলে কন্ট্রোল প্যানেলের ঘুঁটিনাটিও সে পর্যবেক্ষণ করতে পারে কিন্তু ইরন তার কিছুই করল না। হঠাৎ করে সে অনুভব করে তার শরীরে খুব ধীরে ধীরে একটা আরামদায়ক অবসাদ ছড়িয়ে পড়ছে, ঘুমের মতো এক ধরনের অনুভূতি কিন্তু ঠিক ঘুম নয়, প্রাণপণ চেষ্টা করেও সেখান থেকে সে নিজেকে জাগিয়ে রাখতে পারে না। ইরন তার মুখের কাছাকাছি রাখা নীল স্ক্রিনটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল।
ইরনের জ্ঞান ফিরে এল খুব ধীরে ধীরে, চোখ খুলে সামনে নীল স্ক্রিনটাতে পরিচিত নীলাভ গ্রহটা দেখেও সে প্রথমে কিছু মনে করতে পারল না। সমস্ত শরীরে এক ধরনের অবসাদ এবং মাথায় এক ধরনের ভোঁতা যন্ত্রণা নিয়ে সে ধীরে ধীরে পুরোপুরি সজাগ হয়ে ওঠে। ক্যাপসুলের ভিতরে কনকনে এক ধরনের শীতলতা, ইরন তার দুই হাত বুকের কাছে নিয়ে এসে ক্যাপসুলের ভিতরকার কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকাল। মহাকাশটির অসংখ্য তথ্য সেখানে দ্রুত খেলা করে যাচ্ছে, অনভিজ্ঞ চোখে তার কিছুই অর্থবহ নয় কিন্তু ইরন খুব সহজেই সেগুলো বিশ্লেষণ করতে পারে। মিনিট দুয়েক সে তথ্যগুলো দেখে হঠাৎ চমকে উঠল, কোথাও কিছু একটা বড় গোলমাল রয়েছে। গতিবেগ অনেক কম, ত্বরণ যেটুকু থাকার কথা তার এক ভগ্নাংশও নয়, এই সময়ের মাঝে পৃথিবী থেকে যেটুকু যাবার কথা মহাকাশযানটি তার ধারেকাছেও যায় নি। মহাজাগতিক কো–অর্ডিনেট থেকে মনে হচ্ছে এটি মঙ্গল এবং বৃহস্পতির কাছাকাছি কোথাও থেমে আসছে। ক্যাপসুলের ভিতর উঠে বসার উপায় থাকলে ইরন উত্তেজনায় উঠে বসত, কিন্তু এখন তার উপায় নেই। সে সুইচ টিপে বর্গেনের ক্যাপসুলে যোগাযোগ করে এবং সবিস্ময়ে আবিষ্কার করে সেটি খালি, ভিতরে কেউ নেই। ইরন যোগাযোগ মডিউল স্পর্শ করতেই বর্গেনকে দেখতে পেল সে মহাকাশযানের মূল কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ডাকতে গিয়ে ইরন থেমে যায়। বর্গেনের চোখের দৃষ্টি কেমন জানি অস্বচ্ছ এবং দুর্বোধ্য। ইরন তার ক্যাপসুলের ঢাকনা খোলার জন্য জরুরি সুইচটি স্পর্শ করল, এবং ভোঁতা একটি শব্দ করে খুব ধীরে ধীরে স্টেইনলেস স্টিলের কালো ঢাকনাটা উপরে উঠতে শুরু করে। ক্যাপসুলের ভিতরে সাথে সাথে মহাকাশযানের উষ্ণ বাতাস এসে প্রবেশ করে।
ইরন উঠে দাঁড়াল এবং হঠাৎ করে তার মাথা ঘুরে ওঠে, মনে হচ্ছে মহাকাশযানের বাতাসে যথেষ্ট অক্সিজেন নেই। ইরন তার পোশাক থেকে অক্সিজেন মাস্কটি বের করে তার মুখের ওপর লাগিয়ে নিয়ে টলতে টলতে হাঁটতে শুরু করে। বর্গেনের খোলা ক্যাপসুলের পাশেই কীশার ক্যাপসুল, স্বচ্ছ জানালা দিয়ে তার ঘুমন্ত মুখটি দেখা যাচ্ছে। যে। কোনো মানুষকে ঘুমন্ত অবস্থায় কেন জানি অসহায় দেখায়। ইরন একমুহূর্ত দ্বিধা করে উজ্জ্বল লাল রঙের জরুরি সুইচটি স্পর্শ করতেই ক্যাপসুলটি কীশাকে জাগিয়ে তোলার কাজ শুরু করে দেয়। ইরন কীশার জন্য অপেক্ষা না করে মূল নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। কন্ট্রোল প্যানেলের হালকা নীল আলোর সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বর্গেনকে একটি অতিপ্রাকৃত মূর্তির মতো মনে হচ্ছে। ইরন দেয়াল ধরে টলতে টলতে আরো একটু এগিয়ে যেতেই বর্গেন মাথা ঘুরিয়ে ইরনের দিকে তাকাল।
বর্গেন কয়েক মুহূর্ত ইরনের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে শীতল গলায় বলল, ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এসেছ?
হ্যাঁ।
বের হওয়ার কথা নয়।
বর্গেন, তোমারও বের হওয়ার কথা নয়।
আমি এই প্রজেক্টের দলপতি। প্রয়োজনে আমি বের হতে পারি।