আমরা মানুষ নই, মানুষের ক্লোন।
মানুষের ক্লোনও মানুষ। তোমার একটা নাম থাকতে হবে। আমি তোমাকে একটা সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করব না।
মেয়েটি খানিকটা হতচকিত হয়ে পুরুষসঙ্গীর দিকে তাকাল। দুজন দুজনের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে আবার ইরনের দিকে ঘুরে তাকাল। যুবকটি ইতস্তত করে বলল, সত্যি যদি কোনো একটি নাম দিয়ে ডাকতে চাও তা হলে একটি নাম দিতে হবে। কারণ আমাদের কোনো নাম নেই।
তুমি যে মানুষটির ক্লোন তার নাম কী?
আমি যতদূর জানি তার নাম ত্ৰালুস।
বেশ তা হলে তুমিও ত্রালুস।
ইরন এবারে কোমল চেহারার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, আর তোমার?
আমাকে ক্লোন করা হয়েছে মহামান্যা শুমান্তি থেকে।
বেশ। আজ থেকে তা হলে তুমিও হচ্ছ শুমান্তি।
কীশা মাথা নেড়ে হাসিমুখে বলল, চমৎকার! তা হলে প্রজেক্ট আপসিলনের সকল সদস্যের নামকরণ করা হয়ে গেল।
বর্গেন আবার কাঠ কাঠ স্বরে হেসে বলল, সেই নাম কতক্ষণ কাজে লাগবে দেখা যাক।
কীশা ভুরু কুঁচকে বর্গেনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?
বর্গেন কিছু একটা বলতে চাইছিল, ইরন বাধা দিয়ে বলল, ওর কথা থাক। ওর কথা। শুনলে মন খারাপ হয়ে যাবে।
কেন?
কারণ বর্গেন দাবি করে এই অভিযানে আমরা নাকি ব্যাকটেরিয়ার মতো মারা যাব।
কীশা বর্গেনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কেন এ রকম বলছ?
আমি জানি তাই বলছি।
তুমি কেমন করে জান?
কারণ আমি এই প্রজেক্টের দলপতি।
সবাই একসঙ্গে চমকে উঠে বর্গেনের দিকে তাকাল। বর্গেন আবার কাঠ কাঠ স্বরে হেসে উঠে মাথা নেড়ে বলল, না, তোমরা যেটা ডাবছ সেটা আর হবার নয়।
আমরা কী ভাবছি?
তোমরা নিশ্চয়ই ভাবছ যে এই অভিযানে তোমরা যাবে না। তোমাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে মানুষ হিসেবে আমাকে তোমাদের খুব পছন্দ হয় নি।
ইরন এবং কীশা স্থির চোখে বর্গেনের দিকে তাকিয়ে রইল। বর্গেন তাদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, কিন্তু তোমাদের আমার ভারি পছন্দ হয়েছে। এ রকম ক্রু না নিয়ে আমি এই অভিযানে যাচ্ছি না।
বর্গেন আবার আনন্দহীন একটি হাসি হাসতে শুরু করে। যেভাবে হঠাৎ হাসতে শুরু করেছিল ঠিক সেরকমভাবে হাসতে হাসতে হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, তোমরা এখন চল। মহাকাশে অভিযানের আগে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। অত্যন্ত নিরানন্দ একঘেয়ে প্রশিক্ষণ–কিন্তু জরুরি, খুব জরুরি। কারণ মানুষ আসলে ব্যাকটেরিয়ার মতো মারা যেতে পছন্দ করে না। বেঁচে থাকতে চেষ্টা করে যায়। সে জন্য তোমাদের নানারকম প্রশিক্ষণ নিতে। হবে। তোমাদের প্রশিক্ষণ দেবার জন্য কয়েক ডজন টেকনিশিয়ান, ডাক্তার, নার্স আর রোবট অপেক্ষা করছে।
ইরন পাথরের মতো মুখ করে বলল, আমরা যদি না যাই?
বর্গেন হাসিমুখে বলল, তোমরা নিশ্চয়ই যাবে। কারণ যারা প্রজেক্ট আপন্সিলনে নাম লিখিয়েছে তাদের নিজের ইচ্ছা–অনিচ্ছার বিশেষ কোনো মূল্য নেই! মানুষের আর ক্লোনের মাঝে সে ব্যাপারে এখন আর বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। ইরন স্থির চোখে বর্গনের দিকে তাকিয়ে রইল, সে খুব অবাক হয়ে লক্ষ করল তার ভিতরে অসহ্য ক্রোধ পাক খেয়ে উঠছে না, বরং বিচিত্র এক ধরনের কৌতূহল দানা বেঁধে উঠছে।
১.৪ ইরনকে একটি আরামদায়ক চেয়ারে
ইরনকে একটি আরামদায়ক চেয়ারে শুইয়ে যে মেয়েটি নিওপলিমারের স্ট্র্যাপ দিয়ে তাকে শক্ত করে বেঁধে দিচ্ছিল তাকে মোটামুটিভাবে সুন্দরী বলা চলে। ইরন খানিকটা কৌতূহল নিয়ে তার দক্ষ হাতের কাজ দেখতে দেখতে বলল, আমি জানতাম মহাকাশযানে আর এ রকম নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই।
তুমি ঠিকই জানতে।
তা হলে?
এই মহাকাশযানটা একটা পরীক্ষামূলক মহাকাশযান। তোমরা দেখবে, খুব অল্প সময়ে এটা অনেক বেগে পৌঁছে যাবে। সেইজন্য এই ব্যবস্থা।
আমাদের কী হবে?
বিশেষ কিছুই হবে না। শরীরের মাঝে বিশেষ ট্রাকিওশান দেওয়া হয়েছে। সেটা আমাদের সব তথ্য জানাবে। আর তোমাদের যে ক্যাপসুলে ঢোকানো হচ্ছে তার ভিতরে তোমরা খুব নিরাপদ। মায়ের গর্ভে ভ্রুণ যেরকম নিরাপদ অনেকটা সেরকম।
ইরন কৌতুক করে বলল, পূর্ণ বয়সে আবার আমরা মাতৃগর্ভে ফিরে যাচ্ছি?
অনেকটা সেরকম। মেয়েটা ইরনের করোটিতে সুচালো কিছু একটা প্রবেশ করিয়ে বলল, এখন কথা বোলো না, আমাদের ক্যালিব্রেশানে গোলমাল হয়ে যাবে।
ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে চুপ করে গেল। তার দুপাশে আরো চারটি খোলা স্টেইনলেস স্টিলের ক্যাপসুল, কালচে ধাতব রং হঠাৎ দেখে মনে হয় অতিকায় ড্রাগন মুখ হাঁ করে আছে। একেকটি ক্যাপসুলে একেকজনকে শুইয়ে দেওয়া হচ্ছে। নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে একসময় ক্যাপসুলটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। মহাকাশযানের জীবনরক্ষাকারী মডিউল তখন তাদের জীবনের দায়িত্ব নিয়ে নেবে, তাদের নিশ্বাসের জন্য অক্সিজেন, জীবনরক্ষার জন্য চাপ, রক্তের মাঝে পুষ্টির নিশ্চয়তা দেবে কিছু কৌশলী যন্ত্র। মহাকাশযানের শক্তিশালী ইঞ্জিন একসময় গর্জন করে উঠবে, তীব্রগতিতে আয়নিত পরমাণু ছুটে আসবে আর এই মহাকাশযানটি বায়ুমণ্ডলকে ভেদ করে উঠে যাবে মহাকাশে। দেখতে দেখতে নীল আকাশ প্রথমে গাঢ় নীল, তারপর কালচে বেগুনি, সবশেষে নিকষ কালো হয়ে যাবে। পরিচিত পৃথিবী একটি নীলাভ গ্রহ হয়ে পিছনে পড়ে থাকবে। সেই গ্রহটি কি শুধু একটি স্মৃতিই হয়ে থাকবে তাদের কাছে নাকি তারা আবার ফিরে আসবে এই গ্রহে?