ইরন বিড়বিড় করে বলল, সেজন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আরেকটু হলে আমাদের একজন সদস্য আমাদের আরেকজন সদস্যের মাথার ঘিলু বের করে একটা। উদাহরণ তৈরি করতে চাইছিল।
লাল চুলের মহিলাটি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ইরনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না। তবে সেটা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, পুরোটা শুনলে নিশ্চয়ই বুঝব। আমার পরিচয় দিয়ে নিই, আমি কীশা। আমি প্রজেক্ট আপসিলনের একজন অভিযাত্রী। তোমাদের সাথে এই অভিযানে অংশ নিতে পেরে আমি গৌরব অনুভব করছি।
ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি ইরন। আমি কেন্দ্রীয় গবেষণাগারে একজন বিজ্ঞানী হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। ঠিক কী কারণে জানি না আমার জীবন পুরোপুরি ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল, এই অভিযানে অংশ নিয়ে আমি আবার আমার জীবনে খানিকটা সমন্বয় ফিরিয়ে আনতে চাই।
সোনালি চুলের মানুষটি আবার কাঠ কাঠ স্বরে হেসে উঠল। ইরন তার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল, তুমি হাসছ কেন?
তোমার কথা শুনে।
আমার কোন কথাটি তোমার কাছে হাস্যকর মনে হচ্ছে?
জীবনের সমন্বয় ফিরিয়ে আনার অংশটা। জীবন একটা দ্বিঘাত সমীকরণ নয় যে সেটাকে সমন্বয় করে সেখান থেকে সমাধান বের করে আনা যায়। যারা জীবনকে সমন্বয় করার কথা বলে তারা জীবনের অর্থ বোঝে না, সমন্বয়ের অর্থও বোঝে না।
কীশা সোনালি চুলের মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার নাম কী?
আমার নাম বর্গেন।
বর্গেন, প্রথম পরিচয়ে যারা এভাবে কথা বলতে পারে ধরে নেওয়া যেতে পারে তারা সামাজিক পরিবেশে অভ্যস্ত নয়। আমার ধারণা তুমি সম্ভবত একটি রোবট।
বর্গেনের মুখে একটা ক্রোধের ছায়া পড়ে, আমি রোবট নই।
তা হলে তোমাকে নিয়ে আমাদের একটু সতর্ক থাকার প্রয়োজন আছে।
বর্গেন কোনো কথা না বলে কুদ্ধ চোখে কীশার দিকে তাকিয়ে রইল। ইরন জিজ্ঞাসু চোখে কীশার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, আমাদের কেন সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে?
বর্গেন সম্ভবত মৃত্যুদণ্ড পাওয়া একজন আসামি। এই অভিযানে যারা এসেছে তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থাকে।
ইরন এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে বর্গেনের মুখের দিকে তাকাল, মানুষটির মুখে সত্যি এক ধরনের ক্রুর নিষ্ঠুরতার ছাপ রয়েছে। সে ঘুরে কীশার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি এই অভিযানে কেন এসেছ?
আমার ভাগ্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর জন্য। আমার খুব আপনজন ছিল, ভালবাসার মানুষ ছিল সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় একটি দুর্ঘটনায় তারা শেষ হয়ে গেছে। কীশা পাথরের মতো মুখ করে একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমি সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি থেকে পালাতে চাই। তোমরা আমাকে একটু সাহায্য কোরো।
করব কীশা।
কালো গ্রানাইটের টেবিলের দুই পাশে বসে থাকা সপ্রতিভ চেহারার যুবকটি কীশার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি খুব দুঃখিত কীশা। খুবই দুঃখিত। কিন্তু এ রকম পরিবেশে কী বলতে হয় আমি জানি না।
কীশা একটু অবাক হয়ে যুবকটির দিকে তাকাল, ইরন নিচু গলায় বলল, এরা দুজন ক্লোন।
ক্লোন?
যুবকটি মাথা নাড়ল–হ্যাঁ। আমরা ক্লোন। আমাদের যে মানুষ থেকে ক্লোন করা হয়েছে তারা অত্যন্ত প্রতিভাবান এবং সফল মানুষ। তাদের ভিতর সহজাত নেতৃত্ববোধ রয়েছে, তারা সহানুভূতিশীল এবং উদাসী। তাই আশা করা হচ্ছে আমরাও তাদের মতো চরিত্রের মানুষ হব। এই অভিযানে তোমাদের সাহায্য করতে পারব।
নিশ্চয়ই সাহায্য করতে পারবে। কীশা মাথা নেড়ে বলল, আমি নিশ্চিত তোমরা চমৎকার সহযোগী হবে।
জীবন সম্পর্কে আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। গবেষণাগারে কৃত্রিম পরিবেশে আমাদের বড় করা হয়েছে তাই আমরা স্বাভাবিক সামাজিক ব্যাপারগুলো জানি না।
কী বললে–তোমরা কোথায় বড় হয়েছ?
গবেষণাগারে। আমরা সব মিলিয়ে আঠার জন ক্লোন ছিলাম।
আঠার জন? ইরন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, একই মানুষের আঠার জন ক্লোন?
হ্যাঁ। আমরা সবাই এক জন মানুষের ক্লোন ছিলাম।
কীশা কোমল চেহারার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, আর তুমি? মেয়েটির চোখে এক ধরনের ভয়ের ছায়া পড়ে, কাঁপা গলায় বলল, আমিও ক্লোন। আমি অত্যন্ত নগণ্য একজন ক্লোন।
এখানে কেউ নগণ্য নয়। এখানে সবাই প্রয়োজনীয়।
মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, না, আমরা জানি আমরা নগণ্য। মানুষের প্রয়োজনে আমাদের তৈরি করা হয়। সত্যিকারের মানুষের জীবন খুব মূল্যবান, কিন্তু আমাদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। সহজে খরচ করে ফেলবার জন্য আমাদের তৈরি করা হয়।
ইরন ভুরু কুঁচকে বলল, কী বলছ তোমরা?
আমরা সত্যি বলছি। আমাকে যে গবেষণাগারে বড় করা হয়েছে সেখানে আমরা ছিলাম একুশ জন। পরের বার তৈরি করা হয়েছে আরো চব্বিশ জন। আমাদের বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে। যার জিনস ব্যবহার করে আমাদের ক্লোন করা হয়েছে সে অত্যন্ত চমৎকার একজন মহিলা ছিল। আমরা সবাই তার সম্মান রাখার চেষ্টা করি। আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করি। আমরা–_
তোমার নাম কী মেয়ে?
কীশার প্রশ্ন শুনে মেয়েটি থতমত খেয়ে থেমে গেল। নাম? আমার নাম?
হ্যাঁ।
আমাদের কোনো নাম থাকে না। শুধু নম্বর দেওয়া থাকে। আমার নম্বর সতের।
ইরন এক ধরনের বেদনাতুর দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কিন্তু একজন মানুষের নাম নেই, সেটা তো হতে পারে না।