ইরন হেঁটে হেঁটে ঘরের মাঝামাঝি এসে বলল, সে নিশ্চয়ই এসে যাবে।
কেউ কোনো কথা বলল না, ইরন একটা নরম চেয়ারে গা ডুবিয়ে বসে বলল, আমি তোমাদের কথা জানি না, কিন্তু আমার খুব কৌতূহল ছিল তোমাদের দেখার।
সোনালি চুলের মানুষটি মাথা ঘুরিয়ে ইরনের দিকে তাকিয়ে বলল, কেন?
কারণ প্রজেক্ট আপসিলনে যারা যাবে তাদের সবার মাঝে এক ধরনের মিল থাকার কথা।
সোনালি চুলের মানুষটি হঠাৎ এক ধরনের আনন্দহীন হাসি হাসতে শুরু করে। ইরন একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, তুমি হাসছ কেন?
তোমার কথা শুনে।
আমি কি হাসির কোনো কথা বলেছি?
সেটা নির্ভর করবে একজনের রসবোধের ওপর।
তোমার রসবোধ খুব তীক্ষ্ণ?
না। উল্টোটা, আমার রসবোধ নেই।
তা হলে?
তুমি বলছ আমাদের সবার মাঝে এক ধরনের মিল রয়েছে। মিলটি কী জান?
ইরন ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?
আমি বলতে চাইছি যে মিলটি হচ্ছে আমরা সবাই আগামী ছিয়ানব্বই ঘণ্টার মাঝে মারা যাব।
ইরন হঠাৎ কেমন জানি শিউরে ওঠে। সে আবার মাথা ঘুরিয়ে সোনালি চুলের মানুষটির দিকে ভালো করে তাকাল। মানুষটির চেহারা যেরকম কঠোর, তার কথার মাঝেও এক ধরনের অপ্রয়োজনীয় রূঢ়তা রয়েছে। এটি কি তার চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ নাকি প্রথম পরিচয়ে সবাইকে বিভ্রান্ত করার সূক্ষ্ম একটা প্রচেষ্টা কে জানে।
ইরন মুখের মাংসপেশি শক্ত করে বলল, তুমি কেমন করে এত নিশ্চিত হলে যে আমরা সবাই মারা যাব?
সোনালি চুলের মানুষটি এক পা এগিয়ে এসে কালো গ্রানাইটের টেবিলের দুই পাশে বসে থাকা তরুণ–তরুণীকে দেখিয়ে বলল, ওদের জিজ্ঞেস করে দেখ।
ইরন ঠিক বুঝতে পারল না, ভুরু কুঁচকে বলল, কী জিজ্ঞেস করব?
ওরা কারা?
ইরন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সুদর্শন তরুণ এবং কোমল চেহারার মেয়েটির দিকে তাকাল। তারা দুজনেই হঠাৎ কেমন জানি অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তরুণটি ইতস্তত করে বলল, আমরা, আসলে প্রকৃত মানুষ নই।
ইরন চমকে উঠে বলল, তোমরা রোবট?।
না। যুবকটি মাথা নেড়ে বলল, আমরা ক্লোন।
ক্লোন?
হা, বিভিন্ন বিপজ্জনক অভিযানে পাঠানোর জন্য আমাদের পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি করা হয়েছে।
ইরন বিস্ফারিত চোখে এই সুদর্শন যুবক এবং কোমল চেহারার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, আমি–আমি কিছু বুঝতে পারছি না। মানুষকে ক্লোন করা সম্পূর্ণ বেআইনি। একবিংশ শতাব্দীতে।
সোনালি চুলের মানুষটি বলল, তুমি নেহায়েত সাদাসিধে একজন মানুষ। পৃথিবীর কোনো খবর রাখ না।
এই রূঢ় কথাটি শুনে যতটুকু ক্রুদ্ধ হওয়া উচিত ছিল, ইরন কেন জানি ততটুকু ক্রুদ্ধ হতে পারল না। সে সবিস্ময়ে এই ক্লোন তরুণ এবং তরুণীর দিকে তাকিয়ে রইল।
তুমি এখন বুঝতে পারছ আমি কেন বলেছি যে আমরা সবাই আগামী ছিয়ানব্বই ঘন্টার মাঝে মারা যাব?।
ইরন মানুষটির কথার কোনো উত্তর দিল না। সোনালি চুলের মানুষটি স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানালার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, প্রথমত আমরা এমন একটা জিনিস জেনেছি যেটি পৃথিবীর মানুষের জানার কথা নয়–বিপজ্জনক অভিযানের জন্য মানুষকে ক্লোন করা হয়। দ্বিতীয়ত এই অভিযানে মানুষের ক্লোন পাঠানো হচ্ছে। যার অর্থ–
যার অর্থ?
যার অর্থ এখানে মানুষ ব্যাকটেরিয়ার মতো মারা পড়বে। মানুষ যেখানে ব্যাকটেরিয়ার মতো মারা যায় সেখানে ক্লোনকে পাঠানো হয়। কারণ মানুষের ক্লোন আসলে মানুষ নয়।
অবশ্যই মানুষ। ইরন গলা উঁচিয়ে বলল, অবশ্যই তারা পরিপূর্ণ মানুষ। তারা সত্যিকার একজন মানুষের পরিপূর্ণ কপি। তাদের বুকে হৃৎপিণ্ড স্পন্দন করছে, ধমনিতে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে।
হ্যাঁ। যুবকটি মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু পৃথিবীর সংবিধান অনুযায়ী আমরা মানুষ নই। যার জিনেটিক কোড ব্যবহার করে আমাকে তৈরি করা হয়েছিল তিনি ছিলেন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। আমরা নই।
আমি বুঝতে পারছি না। ইরন বিভ্রান্তের মতো বলল, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
সোনালি চুলের মানুষটি ইরনের কাছে এক পা এগিয়ে এসে বলল, এর মাঝে না বোঝার কিছু নেই। আমি যদি তোমাকে আঘাত করি সাথে সাথে প্রতিরক্ষা দপ্তরের লোক এসে আমাকে বেঁধে নিয়ে যাবে। শরীরে ট্রাকিওশান১০ ঢুকিয়ে বিচারের জন্য নিয়ে যাবে। কিন্তু যদি মনে কর আমি একটা শক্ত টাইটেনিয়ামের রড দিয়ে এই দুজনের কারো মাথা ফাটিয়ে ঘিলু বের করে দিই–আমার কোনো অপরাধ হবে না।
কী বলছ?
হ্যাঁ। ঘরের মেঝে নোংরা করার জন্য কয়েক শ ইউনিট জরিমানা হতে পারে কিন্তু মানুষ হত্যা করার জন্য বিচার হবে না।
কী বলছ তুমি?
সোনালি চুলের মানুষটি হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? দেখতে চাও আমি সত্যি কথা বলছি কি না?
ইরন এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে সোনালি চুলের নিষ্ঠুর চেহারার মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। সে কিছু একটা বলতে চাইছিল ঠিক তখন ঘরটির দরজা খুলে যায় এবং প্রজেক্ট আপসিলনের অন্য অভিযাত্রী ঘরে এসে ঢুকল। ইরন মাথা ঘুরিয়ে দেখল, লালচে চুলের একজন মহিলা। বয়স অনুমান করা কঠিন, চব্বিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ যে কোনো কিছু হতে পারে, কিন্তু যেরকম আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রবেশ করেছে বয়স খুব কম হবার সম্ভাবনা কম। মহিলাটিকে সুন্দরী বলা যাবে না তবে আকর্ষণীয় বলা যেতে পারে, চেহারায় একটা ভিন্ন ধরনের সতেজ ভাব রয়েছে। মহিলাটি এগিয়ে এসে সবার দিকে তাকাল এবং একটি চেয়ার টেনে বসে বলল, আমি তোমাদের আলোচনার মাঝে বিঘ্ন করে ফেললাম বলে মনে হচ্ছে।