কমিউনিকেশান্স মডিউলের যত দ্রুত তথ্য নিয়ে আসার কথা তার থেকে কয়েক সেকেন্ড বেশি সময় লেগে যায়। নীলাভ স্ক্রিনে প্রজেক্ট আপসিলনের সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ ত্রিমাত্রিক ভিডিও ক্লিপে ফুটে ওঠে। ইরন ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কারণ সেখানে প্রকৃতপক্ষে কোনো তথ্যই নেই। ইরন নিচু গলায় বলল, পরবর্তী পর্যায়ের তথ্য।
সাথে সাথে প্রথমে স্ক্রিনটি বর্ণহীন হয়ে যায়, পর মুহূর্তে উজ্জ্বল কমলা রঙে নিষিদ্ধ তথ্য প্রতীকচিহ্নটি ফুটে ওঠে এবং সাথে সাথে যান্ত্রিক গলায় উচ্চারিত হয়, প্রজেক্ট আপসিলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের তথ্য সংরক্ষিত। এটি সর্বসাধারণের মাঝে প্রচারের জন্য নয়।
ইরন ভুরু কুঁচকে স্ক্রিনটির দিকে তাকিয়ে থাকে। সে যখন বিজ্ঞান গবেষণাগারে বড় একটি দল নিয়ে ওয়ার্মহোলের ওপর গবেষণা করছিল তখন পৃথিবীর যে কোনো তথ্য তার জন্য উনাক্ত ছিল, এক বছরের মাঝে সে নিচুস্তরের একটি প্রজেক্ট সম্পর্কে তুচ্ছ খানিকটা তথ্যও জানতে পারবে না ইরন কমিউনিকেশান্স মডিউলে গিয়ে চোখের রেটিনা স্ক্যান করিয়ে নিয়ে দ্বিতীয়বার চেষ্টা করতেই হঠাৎ করে প্রজেক্ট আপসিলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের তথ্য আসতে শুরু করে। মূল তথ্য কেন্দ্র এখন তাকে পুরোপুরি আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় নি।
প্রজেক্ট আপসিলন একটি মহাকাশ অভিযান। নতুন একটি জ্বালানি এবং মহাকাশযানের। একটি নতুন নকশা প্রথমবারের মতো পরীক্ষা করা হবে। মহাকাশযানটি সৌরজগৎ থেকে। বের হয়ে আবার ফিরে আসবে, এর গতিবেগ হবে আলোর গতিবেগের এক–দশমাংশ, ত্বরণ হবে অস্বাভাবিক। এই প্রচণ্ড তুরণে মানুষের দেহকে রক্ষা করার একটি নতুন পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা চালানো হবে, পরীক্ষাটির বিপদসূচক সংখ্যা খুব বেশি। সে কারণে যারা জেনেশুনে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে চায় সেরকম অভিযাত্রী খোঁজা হচ্ছে। প্রজেক্ট আপসিলনে যোগ। দিতে চাইলে কোথায় এবং কবে যোগাযোগ করতে হবে সেটিও জানিয়ে দেওয়া আছে।
ইরন খানিকক্ষণ ঠিকানাটির দিকে তাকিয়ে থেকে যোগাযোগ মডিউলটি বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। আকাশের কাছাকাছি একটি অ্যাপার্টমেন্টের উপর থেকে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে একটি বিপজ্জনক মহাকাশযানে সৌরজগৎ পাড়ি দেওয়া তার কাছে মোটেও বেশি আকর্ষণীয় মনে হল না।
কাজেই সেদিন অপরাহ্নে ইরন যখন প্রজেক্ট আপসিলনের নিয়োগ কেন্দ্রে একজন সুন্দরী তরুণীর সামনে নিজেকে আবিষ্কার করল সে নিজের ওপর নিজেই একটু অবাক না হয়ে পারল না। সুন্দরী তরুণটি অত্যন্ত সপ্রতিভ, ইরনকে তার নরম চেয়ারে বসিয়ে সোজাসুজি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ইরন, তুমি কেন এই প্রজেক্টে যোগ দিতে চাও?
ইরন দুর্বলভাবে হেসে বলল, আমি আসলে চাই না।
মেয়েটি হেসে ফেলল, তা হলে তুমি কেন এখানে এসেছ?
আমি এখনো জানি না। আমার ওপর দিয়ে ভাগ্য এমন সব পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালিয়েছে যে কিছুতেই কিছু আসে–যায় না।
তুমি তো জান এই প্রজেক্টের বিপদসূচক সংখ্যাটি অনেক উপরে।
জানি।
আমাদের রেকর্ড বলছে তুমি হতাশাগ্রস্ত একজন বিজ্ঞানী–তুমি কি আত্মহত্যার বিকল্প হিসেবে এটা বেছে নিয়েছ?
যদি বলি হ্যাঁ।
তা হলে তোমাকে আমরা নেব না।
কেন নয়?
আমরা চাই প্রজেক্টটি সফল হোক। হতাশাগ্রস্ত মানুষদের দিয়ে কোনো প্রজেক্ট সফল হয় না।
তা হলে তোমরা আমাকে নেবে না?
সুন্দরী মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, না।
ইরন সোজা হয়ে বসে মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু আমি এই প্রজেক্টে যেতে চাই।
কেন?
কারণ–কারণ– ইরন একটু ছটফট করে বলল, এই প্রজেক্টে যারা আসবে সবাই। নিশ্চয়ই আমার মতো। পৃথিবীর কোনো মানুষ আমাকে বুঝতে পারে না, কিন্তু এই প্রজেক্টের অভিযাত্রীরা আমাকে বুঝবে। আমিও তাদের বুঝব। আমরা একজন অন্যজনকে হতাশার। গহ্বর থেকে টেনে তুলব।
সুন্দরী মেয়েটি নরম চোখে খানিকক্ষণ ইরনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, বেশ। আমি তোমাকে মনোনয়ন দিচ্ছি। কিন্তু মনে রেখো আমি একজন সাধারণ মনোবিজ্ঞানী। আমি শুধুমাত্র প্রাথমিক মনোনয়ন দিই। তোমাকে এরপর সত্যিকারের পরীক্ষা–নিরীক্ষার মাঝে দিয়ে যেতে হবে, শুধু তারপর ঠিক করা হবে তোমাকে এই প্রজেক্টে নেওয়া যায় কি না।
ইরন হঠাৎ হেসে ফেলল, বলল, আত্মহত্যা করার জন্য এত ঝামেলা করতে হয় কে জানত!
মেয়েটি ইরনের দিকে কোমল চোখে তাকিয়ে রইল। কিছু বলল না। ইরন বলল, তুমি একটি জিনিস জান?
কী?
আমি আজ অনেকদিন পর হাসলাম। হাসতে কেমন লাগে ভুলে গিয়েছিলাম।
মেয়েটি হাত বাড়িয়ে ইরনের কাধ স্পর্শ করে বলল, তুমি আবার হাসবে ইরন। আমি নিশ্চিত আবার তোমার জীবনে আনন্দ ফিরে আসবে। নিশ্চয়ই আসবে।
.
পরের কয়েকদিন ইরন খুব ব্যস্ততার মাঝে কাটাল। মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে তার শরীরের প্রায় প্রতিটি কোষকে পরীক্ষা করে দেখা হল, বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা নেওয়া হল, মানসিক ভারসাম্যের সূচক বের করা হল, জরুরি অবস্থায় তার ধীশক্তির পরিমাপ করা হল। রক্তচাপ, মেটাবলিজম, নিউরন বিক্রিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোতে রেটিনার সংবেদনশীলতা পর্যন্ত পরীক্ষা করে দেখা হল।
চতুর্থ দিনে গম্ভীর ধরনের মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ ইরনের হাতে ছোট এক টুকরো ক্রিস্টাল ডিস্ক তুলে দিয়ে বলল, তোমাকে প্রজেক্ট আপসিলনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।