নিশি মাথা নেড়ে বলল, দোহাই তোমাদের আমাকে ফেরত পাঠিও না। আমি প্রতিবিম্ব হয়েই খুব ভালো আছি। কোনো সমস্যা নেই আমার।
সবাই হো হো করে হেসে উঠল। ইরন নিশির মাথার কালো রেশমের মতো চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, আমারও তাই ধারণা।
ইরন স্কাউটশিপ থেকে বের হয়ে আসে, তাদের পিছু পিছু ত্ৰালুস এবং শুমান্তিও বের হয়ে আসে। ত্রালুস তার নিও পলিমারের পোশাকে নিজের কালিমাখা হাত মুছতে মুছতে বলল, আর্কাইভ ঘরের ভন্টে কী রেখেছি দেখবে না?
ইরন ভুরু কুঁচকে বলল, ভন্টে কিছু রেখেছ?
রাখব না? ত্ৰালুস হাসি চেপে রেখে বলল, এত কোটি কোটি ইউনিট খরচ করে এত মানুষজনকে খুন করে, জীবন ধ্বংস করে একটি মহাকাশ অভিযান পাঠিয়েছে ভন্টে করে চতুর্মাত্রিক জগৎ থেকে কিছু আনার জন্য–সেটা খালি রাখি কেমন করে?
কী রেখেছ?
আমাদের এই মহাকাশযানে দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে জান?
জানি।
জিনেটিক কোডিং দিয়ে একটার সাথে আরেকটা জুড়ে দেওয়া যায়। আমি প্রায় সতেরটা হাত, ছয়টা পা, পঞ্চাশটার মতো চোখ, কিছু যকৃৎ, কয়েকটা হৃৎপিণ্ড, কিডনি একসাথে জুড়ে দিয়েছি–
ইরন চোখ কপালে তুলে বলল, কী করেছ? একসাথে জুড়ে দিয়েছ?
হ্যাঁ! সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় সেগুলো কিলবিল করে নড়তে থাকে, কাছাকাছি যেটাই পায় হাত সেটাকেই ধরে ফেলে, পা–গুলো সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, দমাদম লাথি কষিয়ে দিচ্ছে! চোখগুলো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। থলথলে যকৃৎ, নড়তে থাকা হৃৎপিণ্ড, সব মিলিয়ে একটা ভয়ানক জিনিস!
ইরন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ত্ৰালুসের দিকে তাকিয়ে থাকে, তালুস হা হা করে হেসে বলল, পৃথিবীর ঐ বদমাইশ মানুষগুলো যখন আর্কাইভ ঘরের ভল্ট খুলবে তখন সেখান থেকে ওটা কিলবিল করে বের হয়ে আসবে। কী মজা হবে বুঝতে পারছ?
ইরন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।
শুমান্তি খিলখিল করে হেসে বলল, সবচেয়ে মজার ব্যাপার কী জান?
কী?
মানুষগুলো মনে করবে সত্যিই ওটা চতুর্মাত্রিক প্রাণী। ওটা নিয়েই হয়তো বছরের পর বছর গবেষণা করবে!
ঠিকই বলেছ। আমরা যদি ধরা পড়ে যাই তা হলে অন্য কথা।
ত্ৰালুস মাথা নেড়ে মুখ শক্ত করে বলল, আমরা ধরা পড়ব না। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢোকার সময় বাতাসের ঘর্ষণে পুরো মহাকাশযান ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে–এর নানা অংশ পৃথিবীতে ছিটিয়ে পড়বে। স্কাউটশিপটার মাঝে থাকব আমরা কেউ জানবে না!
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, ভাগ্য যদি নেহায়েৎ আমাদের বিপক্ষে না থাকে, আমাদের কেউ ধরতে পারবে না।
শুমান্তি একটু হেসে বলল, যদি ভাগ্যের কথা বল, তা হলে কেউ অস্বীকার করবে না যে আমাদের মতো ভাগ্য পৃথিবীতে কারো নেই।
নিশি মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছ তোমরা। বিশেষ করে আমার ভাগ্য। পুরোপুরি উল্টে গিয়েও বেঁচে আছি!
সবাই হঠাৎ হো হো করে হেসে ওঠে। ত্ৰালুস হাসি থামিয়ে বলল, ভাগ্যের কথাই যদি বল তা হলে সম্ভবত আমি আর শুমান্তি সবার উপরে! ক্লোন হিসেবে আমাদের ব্যাকটেরিয়ার মতো মারা যাবার কথা ছিল! অথচ আমরা চেষ্টা করেও মারা যেতে পারছি না!
শুমান্তি মাথা নাড়ল, বলল, বেঁচে থাকাটা আমার সেরকম ভাগ্যের ব্যাপার মনে হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে তোমাদের মতো চমৎকার মানুষের সাথে পরিচয় হওয়াটা আমার সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য!
ইরন নরম গলায় বলল, সেই সৌভাগ্য আমাদের সবার। ইরনের গলায় কিছু একটা ছিল যে কারণে সবাই হঠাৎ চুপ করে যায়। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে ইরন হেঁটে হেঁটে একটা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। দূরে নীল পৃথিবীকে দেখা যাচ্ছে। যখন সেখানে ছিল বুঝতে পারে নি, দূর থেকে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে সে এই গ্রহটার জন্য, এই গ্রহের মানুষের জন্য গভীর ভালবাসা অনুভব করে। সে একটা নিশ্বাস ফেলে অন্যদের দিকে ঘুরে তাকাল, বলল, আমরা পৃথিবীর কাছাকাছি চলে আসছি। সবার মনে হয় প্রস্তুত হওয়া দরকার।
শেষ কথা
চতুর্মাত্রিক প্রাণীদের জগৎ থেকে ফিরে আসা মহাকাশযানটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার সময় বিধ্বস্ত হয়ে যায়। মহাকাশযানটির মাঝামাঝি রেখে দেওয়া বিস্ফোরকগুলো বিস্ফোরিত হয়ে সেখানে একটা বড় গর্ত তৈরি করেছিল। মহাকাশযানের বাতাস বের হওয়ার সময় গতিপথ পরিবর্তন করে ধ্বংস হয়ে গেছে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া মহাকাশযানের নানা অংশ পৃথিবীর নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে, স্কাউটশিপটি বিধ্বস্ত হয়েছিল দক্ষিণের পার্বত্য এলাকায়। উদ্ধারকারী দল স্কাউটশিপটিকে উদ্ধার করতে পারে নি, সেটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। উদ্ধারকারী দল সেই নির্জন পার্বত্য এলাকায় চার জনের ছোট একটি ভ্রমণকারী দলকে দেখতে পায়। প্রত্যক্ষদর্শী সেই ভ্রমণকারীরা বলেছে, স্কাউটশিপটিতে সম্ভবত কেউ ছিল না–কারণ সেটি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় পাহাড়ে আঘাত করে ধ্বংস হয়ে গেছে। ভ্রমণকারী ছোট দলটি এত বড় একটি বিস্ফোরণ দেখেও বিশেষ বিচলিত হয় নি। পার্বত্য এলাকায় তারা আরো কিছুদিন সময় কাটানোর জন্য রয়ে গেছে। উদ্ধারকারী দল ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করে নি, দুজন তরুণ–তরুণী একজন অপরূপ সুন্দরী কিশোরী এবং তাদের দলনেতা এই স্কাউটশিপে করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্য পাশ থেকে ঘুরে এসেছে। সত্যি কথা বলতে কী, এ ধরনের কোনো সম্ভাবনা থাকতে পারে সেটি জানার মতো মানুষও পৃথিবীতে তখন কেউ নেই।