শুমান্তি মাথা নাড়ল, বলল, জানি না এটাকে ভয় বলে কি না। কেমন জানি ফাঁকা ফঁকা লাগছে। কোনোকিছু নিয়ে আর চিন্তা করতে পারছি না।
ত্রালুস তরল গলায় বলল, চিন্তা করে কী হবে? এস দেখি কী হয়।
চার মিনিটের ভিতর নিশিকে ফেরত দেওয়া হল না। ইরন বুকের ভিতরে এক বিচিত্র ধরনের অস্থিরতা অনুভব করে, অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রেখে বলল, ত্রালুস, জুয়ায় আমরা হেরে গেলাম।
ত্রালুস ইরনের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, আমি দুঃখিত ইরন।
শুমান্তি হাসার চেষ্টা করে বলল, আমাদের কারণে তোমাকে এভাবে মারা যেতে হচ্ছে ইরন, আমরা সত্যিই দুঃখিত
আমি ঠিক জানি না, তোমরা ব্যাপারটিকে নিজেদের দোষ বলে কেন ধরে নিচ্ছ।
ত্ৰালুস মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, এই শেষ মুহূর্তে কার দোষে কী হয়েছে সেটি নিয়ে হিসাব করে কী হবে? তার চাইতে যেটা করে একটু শান্তি পাব সেটাই করি?
কী করে তুমি শান্তি পাবে?
এই চতুর্মাত্রিক প্রাণীকে কষে কিছু গালিগালাজ করলে।
শুমান্তি শব্দ করে হাসল এবং ত্রালুস সত্যি সত্যি তিনটি লেজার দিয়ে আটকে রাখা কুৎসিত মাংসপিণ্ডের মতো চতুর্মাত্রিক প্রাণীটির দিকে এগিয়ে গিয়ে হাত তুলে চিৎকার করে বলল, এই যে চতুর্মাত্রিক প্রাণী তোমরা নাকি নিনীষ স্কেলে পঞ্চম মাত্রার বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রাণী? কাজকর্ম দেখে তো মনে হয় না– আহাম্মক কোথাকার! মেয়েটিকে ফিরিয়ে দিলে বেঁচে যেতে, এখন পুরো গ্রহ নিয়ে তোমরা ধ্বংস হও। ত্রানুস হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, ধ্বংস হও– ধ্বংস হও ধ্বংস হয়ে নরকে যাও!
শুমান্তি লালুসের কাছে গিয়ে তার হাত ধরে বলল, আহ! কী পাগলামো করছ?
ত্ৰালুস হেসে বলল, সময়টা তো কাটাতে হবে। বিস্ফোরণ ঘটাতে এখনো এক মিনিট সময় বাকি। এক মিনিট সময় দীর্ঘ সময় তুমি জান?
ত্রালুসের কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ করে একটা আলোর বিচ্ছুরণ দেখা গেল, সাথে সাথে তাদের সামনে কুৎসিত মাংসপিণ্ডের মতো চতুর্মাত্রিক প্রাণীর একটা অংশ এসে হাজির হল। প্রাণীটি একবার দুলে ওঠে এবং হঠাৎ করে তার ভিতরে একটা কালো গহ্বরের মতো অংশ বের হয়ে আসে। সেখান থেকে প্রথমে আঠালো এক ধরনের তরল গড়িয়ে পড়ে এবং কিছু বোঝার আগেই তার ভিতর থেকে নিশি গড়িয়ে বের হয়ে আসে, তার সারা স্পেসস্যুট চটচটে আঠালো এক ধরনের তরলে মাখামাখি হয়ে আছে। যেরকম হঠাৎ করে প্রাণীটি এসেছিল সেরকম হঠাৎ করে সেটি অদৃশ্য হয়ে গেল। নিশি কোনোমতে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। কাছাকাছি একটা পাথর ধরে আবার সে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে মাথা তুলে তাকাল।
শুমান্তি হঠাৎ অপ্রকৃতিম্ভের মতো হেসে বলল, ত্রালুস, তোমার বকুনিতে কাজ হয়েছে!
উত্তরে কেউ কিছু বলল না, কারো কিছু বলার নেই। ইরন মাথা ঠাণ্ডা রেখে চিন্তা করার চেষ্টা করে, চতুর্মাত্রিক প্রাণী নিশিকে সত্যিই ফিরিয়ে দিয়েছে। বিস্ফোরকের সাথে লাগানো টাইমারটিকে এখন বিকল করা গেলে সবাই বেঁচে যেত। তার আর সময় নেই। পুরো ব্যাপারটি আসলে একটি নিদারুণ রসিকতার মতো হয়ে গেল। অত্যন্ত নিষ্ঠুর একটি রসিকতা।
ত্রালুস ফ্যাকাসে মুখে বলল, এখন আমরা কী করব ইরন?
ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, করার বিশেষ কিছু নেই। তবু চেষ্টা করে দেখা যাক। আমি আর শুমান্তি লেজারগুলো বন্ধ করে প্রাণীটিকে মুক্ত করে দিই। তুমি চেষ্টা করে দেখ বিস্ফোরকের টাইমারকে বিকল করতে পার কি না।
ঠিক আছে।
ত্ৰালুস ছুটে যেতে যেতে শুনল, ইরন বলছে, আমাদের হাতে সময় মাত্র আটচল্লিশ সেকেন্ড।
লেজার তিনটি বন্ধ করামাত্রই প্রাণীটি তার আকৃতি পরিবর্তন করে প্রথমে ছোট হতে হতে একসময় অদৃশ্য হয়ে গেল। এই পুরো গ্রহটিতে এখন শুধুমাত্র চার জন মানুষ–চারজন অসহায় ত্রিমাত্রিক মানুষ।
ইরন জেট প্যাকের কাছে ছুটে গেল, সেখানে ত্রালুস খুব সাবধানে বিস্ফোরকটি আলাদা করে টাইমারের দিকে একটি বিচিত্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইরনকে দেখে মাথা নেড়ে বলল, অসম্ভব, দুই থেকে তিন মিনিটের আগে এই টাইমার বন্ধ করার কোনো উপায় নেই।
ইরন হঠাৎ কেমন জানি দুর্বল অনুভব করে, সবকিছু কেমন যেন অর্থহীন মনে হতে থাকে। সে পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার শুমান্তির দিকে আরেকবার ত্ৰালুসের দিকে তাকাল। নিশি টলতে টলতে এগিয়ে আসছে, সে কিছু জানে না, একদিক দিয়ে সেটি চমৎকার একটি ব্যাপার। ইরন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ত্ৰালুস একটি বিচিত্র দৃষ্টিতে ইরনের দিকে তাকিয়ে বলল, এখন শুধুমাত্র একটি জিনিসই আমরা করতে পারি।
ইরন চমকে উঠল, বলল, কী জিনিস?
সেটা বলতে গেলে সময় নষ্ট হবে। কাজেই আমি বলছি না, আমি করছি, তোমরা দেখ।
ত্রালুস এগিয়ে গিয়ে টাইমার লাগানো ভারী বিস্ফোরকটি কষ্ট করে হাতে তুলে নেয়, তারপর সে ছুটতে শুরু করে। ইরন অবাক হয়ে চিৎকার করে বলল, কী করছ তুমি? ত্রালুস, তুমি কী করছ?
ত্ৰালুস একমুহূর্তের জন্য থেমে বলল, আমি এই বিস্ফোরকটি সরিয়ে নিচ্ছি, ত্রিশ সেকেন্ড সময়ের ভিতরে ওই বড় পাথরটির আড়ালে যদি বিস্ফোরকটি নিতে পারি বিস্ফোরণের পুরো ধাক্কাটি পাথরটা নিয়ে নেবে। তোমরা বেঁচে যাবে।
আর তুমি?
ত্ৰালুস ইরনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বিস্ফোরকটি নিয়ে আবার ছুটতে শুরু করে। ছুটতে ছুটতে চিৎকার করে বলে, বিদায়। শুমান্তি হতচকিতের মতো একবার ত্ৰালুসের দিকে তাকাল, আরেকবার ইরনের দিকে তাকাল, তারপর দ্রুত গলায় বলল, ত্ৰালুস ঠিকই বলেছে, এটিই একমাত্র সমাধান। বিদায়।