হ্যাঁ। নিশিকে যদি ফিরিয়ে দেয়।
ইরন জেট প্যাকটি চতুর্মাত্রিক প্রাণীর একেবারে কাছাকাছি নিয়ে যায়। এন্টি ম্যাটারের বাক্সটি জেট প্যাকের মাঝামাঝি রেখে সেটিকে বিস্ফোরক দিয়ে ঢেকে দেয়। বড় একটি টাইমার দেওয়া বিস্ফোরককে আলাদা করে নিয়ে ইরন সেখানে সময় নির্ধারিত করে দেয়। লেজার রশ্মিটুকু সম্ভবত আরো দশ মিনিট পর্যন্ত থাকবে, সেগুলো শেষ হবার আগেই এই বিস্ফোরণটি ঘটতে হবে, কাজেই সাড়ে সাত মিনিট সম্ভবত পর্যাপ্ত সময়। এর মাঝে যদি কিছু না করা হয় তা হলে ঠিক সাড়ে সাত মিনিট পরে বিস্ফোরণ ঘটবে। এই বিস্ফোরণে এন্টি ম্যাটারের নিরাপদ শীল্ডিং চূর্ণ হয়ে যাবার কথা, সেটি তার ভারী ধাতব বাক্স স্পর্শ করামাত্রই পদার্থ–প্রতিপদার্থের সংঘাতে পুরো পদার্থ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটবে, এ ধরনের বিস্ফোরণ সচরাচর দেখা যায় না, ইরন একটি নিশ্বাস ফেলল, বিস্ফোরণে তারা সাথে সাথে ভস্মীভূত হয়ে যাবে–কিছু বোঝার আগেই। দুঃখ, কষ্ট, ব্যথা, বেদনা, যন্ত্রণা কোনোকিছুর অনুভূতিই তারা পাবে না–যদি দেহটিই না থাকে তা হলে ব্যথা বা দুঃখ–কষ্টটি হবে কোথায়?
এতক্ষণ নিজের ভিতরে যে উত্তেজনা ছিল হঠাৎ করে সেই উত্তেজনাটি কেন জানি কমে গিয়ে ইরন নিজের ভিতরে একটি বিচিত্র ধরনের প্রশান্তি অনুভব করে, তার পক্ষে যেটুকু করার ছিল সে তার পুরোটুকু করেছে, এখন কিছুতেই আর কিছু আসে–যায় না। চতুর্মাত্রিক প্রাণী যদি নিশিকে ফেরত না দেয় এই গ্রহের অর্ধেকটুকুসহ তারা তিন জন কিছু বোঝার আগেই ভস্মীভূত হয়ে যাবে। মৃত্যুর ব্যাপারটিও এখন আর সেরকম ভয়ানক মনে হচ্ছে না।
ইরন হেঁটে হেঁটে শুমান্তির কাছে গিয়ে তাকে ডাকল, শুমান্তি।
বল।
লেজারটা এভাবে শক্ত করে ধরে রাখতে তোমার নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে।
না সেরকম কষ্ট হচ্ছে না।
আমরা খুব বেশি হলে আর মিনিট সাতেক বেঁচে থাকব। জীবনের এই শেষ সময়টা এ রকম কষ্ট না করলেই হয়। লেজারটা সাবধানে নিচে রেখে চলে এস। দূরে দাঁড়িয়ে দেখি কী হয়।
শুমান্তি কিছু বলার আগেই ত্রানুস বলল, ঠিকই বলেছ। শুমান্তি আগে তুমি রাখ, তারপর আমি রাখব।
শুমান্তি বেগুনি রঙের মেগাওয়াট রশিটুকু, যার ভিতর দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে মেগাজুল শক্তি বের হয়ে যাচ্ছে, অপরিবর্তিত রেখে খুব সাবধানে লেজারটি নিচে নামিয়ে রাখে। অস্ত্রটি থেকে তিনটি ধাতব খণ্ড বের হয়ে আসে, তার উপর ভর করে সেটি স্থির দাঁড়িয়ে থাকে।
শুমান্তির লেজারটি স্থির করে দুজন লালুসের কাছে এগিয়ে গেল, তাকেও লেজারটি নিচে বসিয়ে রাখতে সাহায্য করে তারপর তিন জন ধীরপায়ে হেঁটে হেঁটে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন লেজার থেকে ভয়ঙ্কর শক্তিশালী তিনটি লেজার রশ্মি মাটি থেকে কয়েক মিটার উপরে চতুর্মাত্রিক প্রাণীটির একটি অংশকে আটকে রেখেছে, প্রাণীটি এতটুকু নড়তে পারছে না, একটু নড়লেই লেজারের ভয়ঙ্কর রশ্মি সেটিকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে, নিজেকে ধ্বংস না করে এই প্রাণীটির চতুর্মাত্রিক জগতে ফিরে যাবার আর কোনো উপায় নেই।
ইরন একটি নিশ্বাস ফেলে প্রাণীটার নিচে রাখা জেট প্যাকটির দিকে তাকাল। সেখানে টাইমার লাগানো বিস্ফোরকটি অস্পষ্ট এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ করছে। এখান থেকেও টাইমারের সময়টুকু স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে, আর মাত্র ছয় মিনিট বাকি।
ত্রালুস হালকা স্বরে বলল, এটি একটি বিচিত্র অভিজ্ঞতা বলা যায়। আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি সবকিছু নিয়ে ধ্বংস হওয়ার জন্য।
শুমান্তি কোনো কথা বলল না, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ইরন হাসার চেষ্টা করে বলল, এত নৈরাশ্যবাদী হচ্ছ কেন? নিশিকে ফিরিয়ে তো দিতেও পারে।
ত্রালুস, ফিরিয়ে দেওয়ার খুব বেশি সময় নেই। আর মাত্র ছয় মিনিট।
ত্রালুস টাইমারের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমাদের জীবন থেকে মূল্যবান সময় নিতে চাই না, কিন্তু একটা জিনিস নিশ্চয়ই জান?
কী?
নিশিকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু ছয় মিনিট সময় নেই। যদি সত্যিই তাকে ফিরিয়ে দেয় তা হলে আমাদের এই বিস্ফোরকের সাথে লাগানো টাইমারটি বিকল করতে হবে। সেটা করতে কমপক্ষে দুই মিনিট সময় লাগবে। কাজেই নিশিকে ফিরে পাবার জন্য আমাদের হাতে আসলে চার মিনিট থেকেও কম সময়।
ঠিক বলেছ। ইরন মাথা নাড়ল, আর চার মিনিটের মাঝে যদি চতুর্মাত্রিক প্রাণী নিশিকে ফেরত না দেয় তা হলে ধরে নেওয়া যায় আমাদের বিদায় নেওয়ার সময় হয়েছে।
ত্রালুস অন্যমনস্কর মতো একবার আকাশের দিকে তাকাল, ঘোলা আধো আলোকিত আকাশ, চারদিকে বড় বড় পাথর, সবুজাভ কুণ্ডলী পাকানো মেঘ, চারপাশে এক ধরনের বিষাক্ত ধোঁয়া। সে ইরনের দিকে তাকিয়ে বলল, কে জানে কাজটা ঠিক করলাম কি না?
কী কাজ?
এই যে সবাইকে নিয়ে এত বড় একটা জুয়া খেলা।
ইরন হেসে বলল, ছোটখাটো জুয়া খেলার কোনো অর্থই হয় না। সত্যি যদি খেলতেই হয় তা হলে বড় জুয়াই খেলা উচিত।
ঠিকই বলেছ।
তিন জন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। শুমান্তি ত্ৰালুসের পাশে কাছে গিয়ে দাঁড়াল, বায়ু নিরোধক স্পেসস্যুটের মাঝে সবাই আটকা পড়ে আছে, তা না হলে সে নিশ্চয়ই এখন ত্রালুসের হাত ধরে রাখত। ত্ৰালুস শুমান্তিকে নিজের কাছে টেনে নরম গলায় বলল, ভয় করছে শুমান্তি?