সবাই আকাশের দিকে তাকাল। ধূসর আকাশে আলোর বিচ্ছুরণ দেখা যাচ্ছে। থলথলে কুৎসিত মাংসপিণ্ড দেখা দিয়ে আবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ইরন কঠোর গলায় বলল, সবাই অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাক।।
শুমান্তি অস্ত্র হাতে তুলে চারদিকে তাকাল, বলল, ওরা কি আমাদের দেখছে?
ইরন মাথা তুলে তাকাল, চারদিক থেকে ঘিরে আসা আলোর বিচ্ছুরণগুলো আরো কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে, থলথলে মাংসপিণ্ডগুলোকে আরো জীবন্ত বলে মনে হচ্ছে। ইরন গলার স্বর শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলল, ওরা আমাদের দেখছে। সত্যি কথা বলতে কী, আমরা নিজেরা নিজেদেরকে যেভাবে দেখি ওরা তার চাইতে অনেক ভালোভাবে। দেখছে।
শুমান্তি ভয় পাওয়া গলায় বলল, সর্বনাশ!।
ইরন হাতের অস্ত্রটি শক্ত করে ধরে রেখে বলল, আমাদের যেহেতু দেখে ফেলেছে, আমার মনে হয় তা হলে ভালো করেই দেখুক। জানুক যে আমরা কিছুতেই নিশিকে নিতে দেব না। তোমরা অস্ত্র তাক করে নিশিকে ঘিরে দাঁড়াও।
ত্রালুস আর শুমান্তি নিশির দুই পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ত্রালুস কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, যদি হঠাৎ করে হাজির হয় তা হলে কী করব।
গুলি করবে। আমরা যে নিশিকে নিতে দেব না সেটা বোঝানোর আর কোনো পথ আমার জানা নেই।
যদি সত্যিই ওরা বুদ্ধিমান প্রাণী হয়ে থাকে তা হলে ওরা কি আমাদের মনের কথা বুঝতে পারছে না?
আমি জানি না। যদি জেনে থাকে তা হলে ভালো।
কিন্তু দেখা গেল চতুর্মাত্রিক প্রাণীরা ওদের মনের কথা জানে না। নিশিকে ঘিরে রেখে তিন জন স্কাউটশিপের দিকে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই হঠাৎ করে তাদের সামনে প্রথমে একটা তীব্র আলোর বিচ্ছুরণ এবং প্রায় সাথে সাথে থলথলে একটা মাংসপিও হঠাৎ করে তাদের সামনে এসে হাজির হল। মাংসপিণ্ডটি সামনে একবার দুলে উঠে তারপর ধাক্কা দিয়ে তাদের নিচে ফেলে দেয়। কিছু বোঝার আগেই থলথলে মাংসপিণ্ড থেকে অনেকগুলো শুড় বের হয়ে আসে, শুড়গুলো সাপের মতো কিলবিল করে ওঠে। তারপর হঠাৎ সেগুলো বিদ্যুদ্বেগে নিশির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, নিশি ভয়াবহ আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে, তার। মাঝেই খুঁড়গুলো নিশিকে জড়িয়ে নিজের দিকে টেনে নেয়। মাংসপিণ্ডের এক অংশ হঠাৎ করে অন্ধকার গহ্বরের মতো খুলে যায় এবং ঔড়গুলো যাচকা টানে নিশিকে সেই অন্ধকার গহ্বরের মাঝে টেনে নিয়ে যায়। নিশির আর্তচিৎকার হঠাৎ করে থেমে গিয়ে এক ভয়াবহ। নীরবতা নেমে আসে।
ইরন অস্ত্র হাতে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, থলথলে এই মাংসপিণ্ডের মাঝে নিশি আটকা পড়ে আছে, তাকে কি সে এখন গুলি করতে পারবে? গুলির বিস্ফোরণে নিশিও কি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে না? ত্ৰালুস এবং শুমান্তিও উঠে দাঁড়াল। অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে আছে, কী করবে বুঝতে পারছে না।
ইরন দ্রুত চিন্তা করার চেষ্টা করে। একটি চতুর্মাত্রিক প্রাণী ত্রিমাত্রিক জগৎ থেকে একটি ত্রিমাত্রিক প্রাণীকে নিয়ে যাচ্ছে, তাকে কি কোনোভাবে থামানো যায় না? চতুর্মাত্রিক প্রাণীকে কি ত্রিমাত্রিক জগতে আটকানো যায় না? ত্রিমাত্রিক প্রাণী যদি দ্বিমাত্রিক জগতের ভিতর দিয়ে যেত তা হলে কী হত? একটি দ্বিমাত্রিক প্রাণী যদি ত্রিমাত্রিক প্রাণীকে আটকানোর চেষ্টা করত তা হলে কী করত? চিন্তা করার খুব বেশি সময় নেই, কিছু একটা করতে হবে, সামনে ঝুলে থাকা এই থলথলে মাংসপিণ্ডটি একবার অদৃশ্য হয়ে গেলে আর কখনো তারা এই চতুর্মাত্রিক প্রাণীটিকে খুঁজে পাবে না। নিশিকে নিয়ে সে চিরদিনের জন্যে মহাবিশ্বের বিশাল চতুর্মাত্রিক জগতে হারিয়ে যাবে। ইরন থলথলে কুৎসিৎ মাংসপিণ্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে, এখানে নিশ্চয়ই প্রাণীটির চোখ, নাক, মুখ বা অন্য স্পর্শ ইন্দ্রিয় লুকিয়ে আছে, প্রাণীটি হয়তো তাদের। দেখছে, তাদের নির্বুদ্ধিতা দেখে পরিহাস করছে। হয়তো প্রচণ্ড ক্রোধে তাদেরকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে, হয়তো তাদের নিয়ে কৌতুক করছে। কিন্তু এই থলথলে মাংসপিণ্ডটি একবার অদৃশ্য হয়ে গেলে আর তারা এর নাগাল পাবে না। কিন্তু প্রাণীটি অদৃশ্য চতুর্মাত্রিক জগৎ থেকে তাদের দেখতে পারবে। তাদের নিয়ে পরিহাস করতে পারবে, তাদের ওপর ক্রোধান্বিত হতে পারবে। কৌতুক করতে পারবে। এই প্রাণীটিকে কিছুতেই চলে যেতে দেওয়া যাবে না। কিছুতেই না।
ইরন দেখতে পায় সরূসর শব্দ করে এই মাংসপিণ্ডটি তার আকৃতি পরিবর্তন করছে, কখনো বড় হচ্ছে কখনো ছোট হচ্ছে, কখনো তার ভিতর থেকে বিচিত্র অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বের হয়ে আসছে। ইরন জানে প্রাণীটি আসলে তাদের এই জগতের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে, তাই তাদের। কাছে মনে হচ্ছে এটি আকৃতি পরিবর্তন করছে। প্রাণীটির যে অংশ এই জগতের মাঝে রয়েছে সেইটুকুকে এখানে আটকাতে হবে। যেভাবে সম্ভব।
ইরন দ্রুত চিন্তা করার চেষ্টা করে, সময় চলে যাচ্ছে, যে কোনো মুহূর্তে প্রাণীটি অদৃশ্য। হয়ে যেতে পারে, যেটাই করতে হয় সেটা খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। তার মাথায় হঠাৎ একটা সম্ভাবনার কথা উঁকি মারে, ব্যাপারটা আদৌ সম্ভব কি না সে নিশ্চিত নয় কিন্তু এখন আর ভেবে দেখার সময় নেই। সে চিৎকার করে ত্রাস আর শুমান্তিকে ডাকল। তারা গুঁড়ি মেরে কাছে এগিয়ে আসে। ইরন চাপা গলায় বলল, প্রাণীটিকে আটকাতে হবে, যেভাবে, যেভাবে সম্ভব।